তিনি এখনও ‘বাংলাদেশি’ নন!

খবরটা শুনে স্বভাবতই হতাশ হয়েছেন কিংসলে। তাহলে কি এ ক’দিনের পরিশ্রম বৃথা গেলো তার! তবে ভেঙে না পড়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে কিংসেলে বলেছেন, ‘আমার জন্য এটা হতাশার খবর যে আমি বাংলাদেশ দলে খেলতে পারছি না। তবে আমি ঠিক পথেই আছি। নিয়মানুসারে এখন ফিফার ছাড়পত্র না আসলে তো খেলতে পারবো না।’ বাংলাদেশের মেয়ে বিয়ে করে এখানেই থিতু হয়েছেন এলিটা কিংসেলে। পরিবারের আশা ছিল, লাল-সবুজ জার্সি পরে মাঠে নামার সুযোগ পাবেন কিংসলে।

বাংলাদেশের জার্সিতে খেলার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগটাই স্বীকার করেছেন এলিটা কিংসেলে। সেই যুদ্ধটা শুরু করেছিলেন ২০১৬ সালে। সেটি শেষ হলো ২০২১ সালে। তবে পুরোপুরি শেষ হয়েছে বলা যাবেনা। শুরুতে বাংলাদে শিপাসপোর্ট হাতে পেয়েছিলেন গত মার্চে। এরপর পেলেন জাতীয় পরিচয়পত্র।

নাইজেরিয়ান নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করে বাংলাদেশি নাগরিক হয়েও যেন জটিলতা কাটছে না। সর্বশেষ সাফ চ্যাম্পিয়নশীপের চুড়ান্ত দলে জায়গা পাননি। মূলত বাংলাদেশি নাগরিক হওয়ার পরও অনাপত্তিপত্র না পাওয়ার কারণেই প্রাথমিক দলে থেকেও বাদ পড়েছেন এই স্ট্রাইকার। প্রথমবার প্রাথমিক দলে থেকেই মোহাম্মদ হৃদয় সুযোগ পেয়েছেন চুড়ান্ত দলে। সেখানে হৃদয় চমকের পাশে কিংসেলের অপেক্ষাটা আরও বেড়েছে। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপকে সামনে রেখে ২৩ সদস্যের চুড়ান্ত দল ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচ অস্কার ব্রুজোন।

সবাইকে চমকে দিয়ে দলে জায়গা করে নিয়েছেন আবাহনী লিমিটেডের তরুণ ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার মোহাম্মদ হৃদয়। মূলত বাংলাদেশ ফুটবলে ফেডারেশন-বাফুফে সভাপতি কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের পছন্দমতো তাকে দলে নেওয়া হয়েছে। যদিও ৩৫ জনের প্রাথমিক দলে ছিলেন আবাহনীতে সর্বশেষ মৌসুমে আলো ছড়ানো এই খেলোয়াড়।
এরপর এএফসির কাছে তাকে প্রাথমিক দলে নিতে বাফুফের জাতীয় দল ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়।

সেটি অনুমোদন হলেও কিংসেলেকে খেলানোর অনুমতি পাওয়া যায়নি। তাতে হতাশা নেমে এসেছে এই খেলোয়াড়ের চোঁখে মুখে। দল ঘোষনার আগে যখন জানতে পারেন সাফে চুড়ান্ত দলে তার থাকার কোন সম্ভাবনা নেই তখন বঙ্গবন্ধু ষ্টেডিয়ামের সবুজ ঘাসে বসে পড়েন। হয়তো এলোমেলো চিন্তা করতে থাকেন। চেহারায় ফুটে ওঠে প্রাথমকি দলে থেকেও চুড়ান্ত দলে থাকার হতাশা। প্রাথমিক দলে রাখলেও সাফের এ আসরে বাংলাদেশের হয়ে খেলা হচ্ছে না এলিটা কিংসলের। বাফুফে অনেকটা সময় ধরে চেষ্টা করেছিল নাইজেরিয়ান এলিটা কিংসলেকে লাল-সবুজের জার্সিতে খেলানোর।

কিন্তু, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেলেও ফিফা ও এএফসির কাছ থেকে ছাড়পত্র না পাওয়ায় দেশটির হয়ে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে পারবেনা এ ফরোয়ার্ড। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের এবারের আসরে অংশগ্রহণ করতে আজই ঢাকা ছেড়ে যায় বাংলাদেশ দল। গতকালই দল চূড়ান্ত করেন অন্তবরর্তীকালীন কোচ ব্রুজোন। কিসলে ছাড়াও প্রাথমিক দল থেকে বাদ পড়েছেন চট্টগ্রাম আবাহনীর মিডফিল্ডার মানিক হোসেন মোল্লা, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ডিফেন্ডার মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের ডিফেন্ডার মেহেদী হাসান।

প্রথমবারের মতো ডাক পাওয়ার পর দলের সঙ্গে থেকে নিয়মিতই অনুশীলন করে গেছেন। কথা বলেছেন গণমাধ্যমের কর্মীদের সঙ্গেও। কিন্তু এলিটা কিংসেলের বাংলাদেশ দলের জার্সি গায়ে চড়ানোর অপেক্ষাটা তবুও যেন শেষই হচ্ছে না।
ঠিক এই একই কারণে এএফসি কাপেও মালদ্বীপ গিয়ে খালি হাতে ফিরতে হয়েছিল কিংসেলেকে। দলের সঙ্গে অনুশীলন করে পারেননি বসুন্ধরা কিংসের জার্সি গায়ে মাঠে নামতে।

বাফুফে এরপর কিরগিজস্তানে ত্রিদেশীয় সিরিজেও তাকে খেলোনোর চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু সেখানেও সফলকাম হতে পারেনি। এখানে বাফুফের সাংগঠনিক ব্যর্থতা রয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানাজন অনেকরকম মন্তব্য করছেন। তবে কিংসলেকে দলে টানতে আরও একটু অপেক্ষা করার সুযোগটা হাতে ছিল কোচ অস্কার ব্রুজোনের।

সেক্ষেত্রে টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ম্যানেজার্স মিটিংয়ে দিতে হতো দলের সদস্যদের নাম। তার আগেই দল চূড়ান্ত করে ফেলেছেন বাংলাদেশের স্প্যানিশ কোচ। তাকে নিয়ে আলাগা কোন চিন্তায় থাকতে চাননি বলেই ঠিক সময়ে দল ঘোষণা করেন তিনি। এদিকে কোন অস্কার নাকি কিংসেলে খুব একটা পছন্দ করেন না। সে কারণে শেষের সুযোগটা নেননি।
প্রাথমিক দলে সুযোগ পাওয়ার কারণে স্বপ্নটা বাড়বাড়ন্ত হচ্ছিল কিংসেলের।

এরপর সুযোগ এলো বাংলাদেশ দলে খেলার, চুড়ান্ত দল ঘোষনার পরই ছিটকে গেলেন। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে জামাল-সুফিল-জিকোদের সঙ্গে ঘামও ঝরিয়েছেন। কিন্তু তখনও জানতে না দু:সংবাদটি  খ্রবু দ্রততম সময়ের মধ্যেই অপেক্ষা করছে তার জন্য। ফিফার ছাড়পত্র না আসায় আপাতত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলা হচ্ছে না ৩১ বছর বয়সী তারকা স্ট্রাইকারের।

খবরটা শুনে স্বভাবতই হতাশ হয়েছেন কিংসলে। তাহলে কি এ ক’দিনের পরিশ্রম বৃথা গেলো তার! তবে ভেঙে না পড়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে কিংসেলে বলেছেন, ‘আমার জন্য এটা হতাশার খবর যে আমি বাংলাদেশ দলে খেলতে পারছি না। তবে আমি ঠিক পথেই আছি। নিয়মানুসারে এখন ফিফার ছাড়পত্র না আসলে তো খেলতে পারবো না।’ বাংলাদেশের মেয়ে বিয়ে করে এখানেই থিতু হয়েছেন এলিটা কিংসেলে। পরিবারের আশা ছিল, লাল-সবুজ জার্সি পরে মাঠে নামার সুযোগ পাবেন কিংসলে।

এর আগে বাংলাদেশের খেলাধুলার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিদেশি একজনের ‘বাংলাদেশি’ হওয়ার রেকর্ড গড়েছেন এলিটা কিংসেলে। বসুন্ধরা কিংসের হয়ে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটির বিপক্ষে খেলার মাধ্যমে নতুন দিগন্তে পা রেখেছে ফুটবল। একজন বিদেশি খেলোয়াড়ের ’বাংলাদেশী’ নাগরিকত্ব নিয়ে খেলার ঘটনা এটাই প্রথম। এর আগে খেলাধুলায় মাত্র দুজন বিদেশিকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছিল। প্রথমজন বক্সিংয়ের কিংবদন্তী মোহাম্মদ আলী, দ্বিতীয়জন ক্রিকেটের গর্ডন গ্রিনিজ।

গর্ডনকে নাগরিকত্ব দেবার মূল কারণ ছিল বাংলাদেশকে আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন করিয়ে বিশ্বকাপে নিয়ে যাওয়া। আর এবার পুরোপুরি ভিন্ন কারণে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন এলিটা কিংসেলে। নিজ দেশ নাইজেরিয়ার নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন মূলত বাংলাদেশী মেয়ে লিজাকে বিয়ে করার কারণে। পাশাপাশি নিজের দেশে ফুটবলে জাতীয় দলে খেলার আশা না থাকাটাও একটা বড় কারণ। সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশের জাতীয় দলে যারা ষ্ট্রাইকার হিসেবে খেলছেন আন্তর্জাতিক ম্যাচে তাদের ব্যর্থতাও যোগ হয়েছে তাতে।

মূলত বছর চারেক আগে ঢাকার মাঠে খেলা বয়সে কম বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়দের নাগরিকত্ব দেবার একটা উদ্যোগ গ্রহন করেছিলেন বাফুফের জাতীয় দল ব্যবস্থাপনা কমিটি। কিন্তু সর্বমহল থেকে এ নিয়ে ব্যপক প্রতিবাদের মুখে পড়ে অনেকটা বাধ্য হয়েই সেই পরিকল্পনা থেকে পিছু হটে বাফুফে। কিন্তু জাতীয় দলে দক্ষ গোলস্কোরারের অভাব এরপরও পূরণ হয়নি। বাংলাদেশকে ভালবেসে এদেশের নাগরিকত্ব নেওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, লাল সবুজ জার্সি গায়ে খেলা। এলিটাকে এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।

যেমন করে ‘বাংলাদেশি’ হতে গিয়ে তাকে বেশ সংগ্রাম করতে হয়েছে। নাইজেরিয়ান হিসেবে খেলবেন বলে গত ১৬ মাস ছিলেন না প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে। শুরুতে নিজ দেশের নাগরিকত্ব বাতিল চেয়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর চলতি বছরের মার্চে হাতে পান বাংলাদেশী পাটপোর্ট। একটা ধাপ পেরিয়ে এরপর অপেক্ষায় থাকেন জাতীয় পরিচয়পত্রের।

কারণ ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে প্রমাণের জন্য পাসপোর্টের পাশাপাশি এনআইডি কার্ডও লাগবে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে আবার সেটি পেতে বিলম্ব হচ্ছিল। একাধিকবার লকডাউনের কারণে অফিসই বন্ধ ছিল। এদিকে আবার এএফসি (এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন) কাপের সময় চলে আসে। অন্যদিকে অপেক্ষা বাড়তে থাকে এলিটার। তারিখ নির্ধারনের পর অনেক নাটকীয়তা শেষে মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত আসর স্থগিত হয়ে যায়।

এনআইডি হাতে না পাওয়ায় স্থস্তির নি:শ্বাস পেলেন তিনি। এরপর আবার এলিটার ক্লাব বসুন্ধরা কিংস এএফসি কাপ পেছানোর আবেদন করে। এশিয়ার ফুটবল অভিবাবকরা আবেদনে সাড়া দিয়ে আসরটি পিছিয়ে আগস্ট মাসে নিয়ে যায়। এরপর চলতি জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে এলিটার হাতে চলে আসে কাঙ্খিত এনআইডি কার্ড।

সাফে ২৩ জনের বাংলাদেশ দল

  • গোলরক্ষক : আনিসুর রহমান জিকো, শহীদুল আলম সোহেল, আশরাফুল ইসলাম রানা।
  • ডিফেন্ডার : বিশ্বনাথ ঘোষ, তপু বর্মন, কাজী তারিক রহমান, টুটুল হোসেন বাদশা, রহমত মিয়া, রিয়াদুল হাসান রাফি, ইয়াসিন আরাফাত, রেজাউল করিম রেজা, মোহাম্মদ হৃদয়।
  • মিডফিল্ডার : আতিকুর রহমান ফাহাদ, সোহেল রানা, মো: সাদ উদ্দিন, জামাল ভুঁইয়া, রাকিব হোসেন।
  • ফরোয়ার্ড : মাহবুবুর রহমান সুফিল, মোহাম্মদ ইব্রাহিম, মতিন মিয়া, জুয়েল রানা, সুমন রেজা, বিপলু আহমেদ।
  • বাদ পড়েছেন : মেহেদী হাসান, মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান, মানিক হোসেন মোল্লা, এলিটা কিংসলে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...