অভাগা এগারোর অধরা বিশ্বকাপ

ফুটবলে অভাগা সেরা খেলোয়াড়দের সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়। মেসি-রোনালদোও রয়েছেন এ তালিকায়। তবে তারা এখনও খেলছেন। তাই তাদেরকে বাদ রেখেই এবারে একটা তালিকা তৈরি করার প্রচেষ্টা; তাদের তালিকা যারা যেতেননি সোনালী সেই ট্রফিটি।

মারাকানা স্টেডিয়ামে তিল ধারণের ঠাঁই নেই, সবার অপেক্ষা কার হাতে উঠতে যাচ্ছে সোনালী ট্রফিটা। অধীর আগ্রহে সবার চোখ ফুটবল মাঠের সেই সবুজ গালিচায়।

ম্যাচের নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলা শেষ। চলছে অতিরিক্ত সময়ের খেলা। তখনো গোল শূন্য ড্র-তেই রয়েছে খেলা। সবাই হয়ত প্রত্যাশা করছিলো ফুটবলের এই মহারণে ট্রাইবেকারে হোক ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ। কিন্তু নিয়তি চমকে দেবার একটা উপলক্ষ হাত ছাড়া করবেন তা কি করে হয়? ম্যাচের ১১৩ মিনিটে মারিও গোটজের গোল। চোখের সামনে থেকে ট্রফিটা হাত ছাড়া হয়ে গেলো ইতিহাসে সেরাদের সেরা লিওনেল মেসির।

ফুটবলে অভাগা সেরা খেলোয়াড়দের সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়। মেসি-রোনালদোও রয়েছেন এ তালিকায়। তবে তারা এখনও খেলছেন। তাই তাদেরকে বাদ রেখেই এবারে একটা তালিকা তৈরি করার প্রচেষ্টা; তাদের তালিকা যারা যেতেননি সোনালী সেই ট্রফিটি।

  • ডেভিড বেকহ্যাম (ইংল্যান্ড)

‘বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যাম’ ফুটবল বিশ্বে সুপরিচিত এক উক্তি। বেকহাম ছিলেন তাঁর সময়কার অন্যতম সেরা একজন খেলোয়াড়। তাঁর অসাধারণ ফ্রি-কিক গুলোই ছিল ভক্তদের আকর্ষনের প্রধান বিষয়। দর্শকদের অপেক্ষা কখন একটা ডি-বক্সের আশেপাশে একটা ফ্রি-কিক পাবে ইংল্যান্ড কিংবা ম্যান ইউ অথবা মাদ্রিদ। আর বেকহাম দেখাবেন তাঁর অসাধারণ ফ্রি-কিক শৈলী।

তাছাড়া খেলা ছাড়াও তাঁর চলাচল কিংবা তাঁর ফ্যাশন ছিল অনুকরণীয়। খেলার পাশাপাশি সেসব কারণেও আলোচনায় ছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর কপালেও জোটেনি সোনার হরিণ, বিশ্বকাপ ট্রফি। ১৯৯৮ তে রাউন্ড অব সিক্সটিনে তাঁর ভুলে ছিটকে যায় ইংল্যান্ড। ২০০২ তে সেবারের বিশ্বকাপ জয়ী দল ব্রাজিলের কাছে ২-১ এ হেরে বিদায় ঘটের বেকহামদের। অধরা থেকে গেলো শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট।

  • জর্জ হ্যাজি (রোমানিয়া)

রোমানিয়ার হয়ে তিন তিনটি বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া খেলোয়াড় তিনি। তাঁর সময়কার অসাধারণ এক ইউঙ্গার ছিলেন হ্যাজি। তাঁর চাহিদা কিংবা খেলার মানের প্রমাণ হতে পারে বার্সেলোনা আর রিয়াল মাদ্রিদের তাঁকে নিয়ে করা দর কষাকষি। তিনি তাঁর একক নৈপূন্যে দলকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল অবধি।

  • জাঁ ফন্টেইন (ফ্রান্স)

ফনটেইনের আক্ষেপ যে শুধুই বিশ্বকাপ ছোঁয়া তা নয়। তিনি তাঁর খেলোয়াড়ী জীবনে প্রশংসা থেকেও হয়েছেন বঞ্চিত। পেলে, গারিঞ্চা, ভাভাদের মত অতিদানবীয় ফুটবলারদের মাঝে তিনি হারিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৫৮ এর সেই বিশ্বকাপে করেছিলেন ১৩ গোল ঝুলিতে তুলে নিয়েছিলেন গোল্ডেন বুট আর ব্রোঞ্জ বল। বিশ্বকাপটা আর ছোঁয়া হয়ে ওঠেনি তাঁর।

  • ডেনিস বার্গক্যাম্প (নেদারল্যান্ডস)

নেদারল্যান্ডের এই কৃতি খেলোয়াড় নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করে গেছেন দলের হয়ে, নিজের জন্যের একটা বিশ্বকাপ বাগিয়ে নিয়ে আসতে। কিন্তু তাঁর দলের তেমন কোন সহয়তা তিনি পাননি, অধরাই থেকে গেলো তাঁর বিশ্বকাপ জয়ের আশা। অথচ ১৯৯৮ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে করা গোলটি স্মরণীয় হয়ে রয়েছে ফুটবল ভক্তদের মাঝে।

  • লেভ ইয়াসিন (সোভিয়েত ইউনিয়ন)

১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপের তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে শেষ চারে তোলার পুরো কৃতিত্ব এই লেভ ইয়াশিন। তিনি পরিচিত ছিলেন তাঁর অসাধারণ রিফ্লেস্কের কারণে। ব্ল্যাক প্যান্থার উপাধী পাওয়া এই খেলোয়াড়ের হাতকেও সোভিত করতে পারেনি বিশ্বকাপের সেই ট্রফিটা

  • ইয়োহান ক্রুইফ (নেদারল্যান্ডস)

নির্দ্বিধায় নেদারল্যান্ডস ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে স্কিলফুল ও নান্দনিক খেলোয়াড় ছিলেন ইয়োহান ক্রইফ। ডাচদের ইতিহাসে বললে কিছুটা ভুল বলা হয়। তিনি ছিলেন ফুটবলের ইতিহাসে অন্যতম সেরা একজন খেলোয়াড়। বার্সেলোনা, আয়াক্স, নেদারল্যান্ডস দলের টোটাল ফুটবলের প্রবর্তক এই তারকা ফুটবলার। তিনি এই অভাগাদের তালিকায় সবচেয়ে বড় নাম। তার কপালেও জোটেনি বিশ্বজয়ের পরম আনন্দ।

  • আলফেডো ডি স্টেফানো (স্পেন-আর্জেন্টিনা-কলম্বিয়া)

রিয়াল মাদ্রিদ ফুটবলকে যে নতুন মোড় এনে দিয়েছিলেন তিনি হলেন এই আলফ্রেডো ডি স্টেফানো। ১৯৫০ শতকে মাদ্রিদের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় বিশ্বকাপ খেলেছিলেন কলম্বিয়ার হয়ে। রিয়াল মাদ্রিদের তৎকালীন সময়ে আর্জেন্টিনার বংশভুত এই খেলোয়াড় আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া ও স্পেন – তিনটি ভিন্ন জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন। তবে আফসোস! তাঁর ক্যাবিনেতা তিনি সুসজ্জিত করতে পারেননি, বিশ্বকাপ দিয়ে। পারবেন কি করে, বিশ্বকাপে একটা ম্যাচও খেলার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর।

  • ফেরেঙ্ক পুসকাস (হাঙ্গেরি)

ফুটবলের অন্যতম সম্মানজনক পুরস্কার দেওয়া হয় তাঁর নাম অনুসারে। মৌসুমের সবচেয়ে সুন্দর গোলদাতাকে দেওয়া হয় ‘পুসকাস পুরস্কার’। কিন্তু যার নামে এই পুরস্কার তিনি নিজে মানে খোদ ফেরেঙ্ক পুসকাস ব্যর্থ হয়ে এই অভাগাদের তালিকায় নিজের নামটি লিখিয়েছেন।

তিনি তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনে ৫৩০ ম্যাচে করেছেন ৫১৪টি। জাতীয় দলের হয়েও করেছেন ৮৪ গোল। তাঁর হাত ধরেই ১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠেছিল তাঁর দেশ হাঙ্গেরি। ফাইনালে ৩-২ ব্যবধানে পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরে পুসকাসের বিশ্বকাপ জয় থেকে যায় ধরা ছোয়ার বাইরে।

  • মিশেল প্লাতিনি (ফ্রান্স)

তিন তিন বার বছরের সেরা খেলোয়াড় হবার কৃতিত্ব যার রয়েছেন তিনিই মিচেল প্লাতিনি। ৮০ দশকে ফ্রান্স জাতিয় দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ প্লাতিনি ছুঁয়ে দেখতে পারেননি বিশ্বকাপ। ম্যাচ ফিত না থাকা সত্ত্বেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন ১৯৮৬ বিশ্বকাপে। তবুও তিনি দলকে সেমিতে তুলতে করেছিলেন গুরুত্বপুর্ণ দু’টি গোল। সেবারের পর কালের গর্ভে ক্রমশ তলিয়ে যেতে থাকেন তিনি।

  • মার্কো ভ্যান বাস্তেন (নেদারল্যান্ডস)

নেদারল্যান্ডস ইতিহাসে অন্যতম সেরা ১৯৯০ বিশ্বকাপ দলের সদস্য ভ্যান বাসতেন ছিলেন অসাধারণ প্রতিভাবান একজন খেলোয়াড়। তাঁর অসাধরণ সব পাস ও গোল করাবার সক্ষমতায় মাতিয়ে রাখতেন মাঠের দর্শকদের। প্রতিভাবান এই খেলোয়াড় রয়েছেন অজয়ীদের তালিকায়।

  • জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ (সুইডেন)

সুইডেন ফুটবলের অন্যতম পরিচিত মুখ জলাতান ইব্রাহিমোভিচ। ইউরোপীয় ফুটবলের নিয়মিত অসাধারণ সব গোল করে যাওয়া ইব্রাহিমোভিচ জাতীয় দলের হয়ে জিততে পারেননি বিশ্বকাপ। এর পেছনে হয়ত দায়ী তাঁর সতীর্থরা, যারা বারংবার ব্যর্থ হয়েছেন তাঁকে সঠিক সঙ্গ দিতে। যার ফলশ্রুতিতে ইব্রাহিমোভিচের ভাগ্যে জোটেনি জাতীয় দলের হয়ে কোন শ্রেষ্ঠত্বের তকমা। তবুও তাঁর অসাধারণ সব গোল গুলো থেকে যাবে তাঁর মত অমলিন।

এত এত তারকার হাতে কখনো উঠেনি প্রায় ছয় কিলোগ্রামের সেই সোনালী ট্রফিটা। এদের পাশাপাশি আরো যোগ হবেন পাওলো মালদিনি, ওলিভার কান, স্টিভেন জেরার্ড, রাউল গঞ্জালেস, জিকো, সক্রেটিস, লুইস ফিগো, জর্জ বেস্ট সহ আরো অনেক কীর্তি মানে ফুটবলাররা।

কিংবা হালের লিওনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো বা নেইমাররাও এখনও জিতেননি বিশ্বকাপ। আসল অভাগাটা কে তা ভাবনার বিষয়। অভাগা কি এই সেরা খেলোয়াড়েরা নাকি তাদের হাতকে সুসজ্জিত করতে পারেনি যে ট্রফি? প্রশ্নটা তোলা থাক, উত্তরের সন্ধান চলতে থাকুক শেষদিন অবধি।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...