নেতৃত্বে সফল তামিম নাকি শুভঙ্করের ফাঁকি!

অধিনায়ক তামিম এখন পর্যন্ত বেশ সফল। অন্তত পরিসংখ্যানের মানদণ্ডে তাঁকে ব্যর্থ বলার কোনো উপায় নেই। তবে সে সব পরিসংখ্যানকে সূক্ষ্মভাবে কাঁটাছেড়া করলে আবার অধিনায়ক তামিম বড্ড গড়পড়তা রূপেই চিত্রায়িত হবেন। 

‘পরিসংখ্যান হলো আস্ত একটা গাঁধা’- কথাটা বলেছিলেন ইংলিশ প্রথিতযশা ক্রিকেট লেখক নেভিল কার্দাস। ইংলিশ এ  ভদ্রলোকের এই চিয়ায়ত কথার সূত্র ধরেই বাংলাদেশের ক্রিকেটে একটা সাদৃশ্যতা অঙ্কন করা যায়।

আচ্ছা, বলুন তো! সফলতার হার বিবেচনায় মাশরাফির পরে ওয়ানডে ক্রিকেটে সবচেয়ে সফল অধিনায়ক কে? অন্তত ১০ ম্যাচের মানদণ্ডে, নামটা তামিম ইকবাল। অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফি ৫৮.১৩ শতাংশ ম্যাচে জয় পেয়েছেন আর তামিম পেয়েছেন ৫৬.৬৬ শতাংশ সফলতা।

এই সফলতার ধারাবাহিকতায় আসন্ন ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপেও বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন তামিম ইকবাল। অধিনায়ক তামিম এখন পর্যন্ত বেশ সফল। অন্তত পরিসংখ্যানের মানদণ্ডে তাঁকে ব্যর্থ বলার কোনো উপায় নেই। তবে সে সব পরিসংখ্যানকে সূক্ষ্মভাবে কাঁটাছেড়া করলে আবার অধিনায়ক তামিম বড্ড গড়পড়তা রূপেই চিত্রায়িত হবেন।

কিভাবে সেটা? ২০২০ সালে বাংলাদেশের ওয়ানডে দলের নেতৃত্বে আসেন তামিম। তবে মাশরাফির উত্তরসূরি হিসেবে পাওয়া সে দায়িত্ব তামিমকে পালন করতে হয় তারও প্রায় এক বছর পর। করোনার কারণে সে সময় প্রায় এক বছর বাংলাদেশের ক্রিকেট বন্ধই ছিল। তাই মাঠের ক্রিকেটে অধিনায়ক তামিমের অভিষেক হতেও বিলম্ব হয়েছিল।

অভিষেক বললে অবশ্য কিছুটা ভুল বলা হবে। কারণ তামিম এর আগেই ২০১৯ সালে মাশরাফির অনুপস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন অধিনায়ক হিসেবে বাংলাদেশকে ৩ টি ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেছিলেন। যদিও তাঁর কাপ্তানিতে সেই ৩ টি ম্যাচই হেরেছিল বাংলাদেশ।

অধিনায়ক হিসেবে শুরুর ঐ অংশটা বাদ দিলে পরের যাত্রাপথে তামিম বেশ সফল। দীর্ঘমেয়াদে অধিনায়ত্বের সময়কালে বাংলাদেশকে ২৭ টা ম্যাচ নেতৃত্ব দিয়েছেন। এর মধ্যে ১৭ টাতেই জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ সফলতার হার প্রায় ৬৩ শতাংশ। কিন্তু গলদটা আবার এখানেই। শুভঙ্করের ফাঁকিটা লুকিয়ে এই পরিসংখ্যানেই।

তামিম অধিনায়কত্ব নেওয়ার আগেই ওয়ানডে ক্রিকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কা, জিম্বাবুয়ে আর আফগানিস্তানের চেয়ে শক্তিধর দল বাংলাদেশ। আর তামিমের সফলতা ঠিক এই চার দুর্বলতম প্রতিপক্ষে বিপক্ষেই।

এই চার দলের বিপক্ষে বাংলাদেশকে ১৮ ম্যাচে অধিনায়কত্ব করে পেয়েছেন ১৪ টিতেই জয়। এখন এই দলগুলোর বিপক্ষে বাংলাদেশ আগেও সফল ছিল। কিন্তু তামিমের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানটা অনেক গ্লোরিফাই হয়ে যায়। যেখানে আদৌতে এমন সব সফলতায় তৃপ্ত হওয়ার মতো কিছু নেই।

মাশরাফির অধিনায়কত্বে ৮ বছর আগেই জিম্বাবুয়েকে ৫-০ তে হোয়াইট করেছিল বাংলাদেশ। আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতেই তাঁর অধীনে ক্যারিবিয়ানদের সিরিজ হারিয়েছিল বাংলাদেশ। আফগানিস্তান এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জিততে পারেনি। শ্রীলঙ্কাও ওয়ানডে ক্রিকেটের বিবেচনায় শেষ ৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে কিছুটা পিছিয়ে।

তামিমের অধিনায়কত্বে এই দলগুলোর বিপক্ষে জয় বাংলাদেশকে শক্তিমত্তায় একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছে ঠিকই। কিন্তু এই সফলতায় নতুনত্ব কিছু নেই। অন্তত তামিমের নামের পাশে এখনই ঘটা করে সফল তকমা দেওয়ার মতো কিছু নেই।

তবে কি তামিম ইকবালের অধিনায়কত্বে বলার মতো কোনোই সাফল্যের ইতিহাস নেই? অবশ্যই আছে। গত বছরে বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ জিতেছিল প্রোটিয়াদের মাটিতেই। যা বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে আর কোনো অধিনায়ক দেখাতে পারেননি। তবে এই বড় প্রতিপক্ষের পরিসংখ্যান আসলেই কিন্তু তামিম আবার অধিনায়ক হিসেবে ম্লান হয়ে পড়বেন।

শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জিম্বাবুয়ে, আফগানিস্তান বাদ দিলে ৯ টি ম্যাচে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তামিম। কিন্তু তাতে জয় এসেছে মাত্র ৩ টিতে। অর্থাৎ এই জায়গাতে তামিমের সফলতার হার মাত্র ৩৩.৩৩ শতাংশ। যে একটি চিত্রই তামিমকে গড়পড়তা অধিনায়কের স্বীকৃতি দিতে সক্ষম।

এবার আসা যাক, অধিনায়ক হিসেবে তামিম নিজের পারফর্ম্যান্স ঠিক কতটা ধরে রেখেছেন। সামগ্রিক চিত্র বলে, ২০২০ এর পর ৩৭.৬৪ গড়ে ৯৪১ রান করেছেন তামিম। যার মধ্যে ৮ টা ফিফটি আর ১ টি সেঞ্চুরি ছিল। এমন পরিসংখ্যানকে মোটেই খারাপ কাতারে ফেলা যায় না। বরং বাংলাদেশি ব্যাটারদের বিবেচনায় বেশ ভাল।

তবে এই ৯৪১ রানের মাঝে তামিম এক জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই দুই সিরিজে করেছেন ২৪৪ রান। জিম্বাবুয়ে বাদ দিলে তামিমের গড়টা নেমে যায় ৩৩ এ। যদিও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ বাদ দিলে দক্ষিণ আফ্রিকা আর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে অন্তত একটি করে ফিফটি করেছেন এ ব্যাটার।

সব মিলিয়ে অধিনায়ক থাকাকালীন ব্যাট হাতে খারাপ করেননি তামিম ইকবাল। শেষ এক বছরে সবচেয়ে বেশি রান এসেছে তাঁর ব্যাট থেকেই। তারপরও তাঁর এই ব্যাটিংয়ের চিত্রকে গড়পড়তা ছাপিয়ে দারুণ কিছু বলা যাচ্ছে না নিশ্চিতভাবেই।

অধিনায়ক হিসেবে বড় দলগুলোর বিপক্ষে তামিমের এই ৩৩.৩৩ শতাংশ জয়ের হারই মূলত সামগ্রিক চিত্র পাল্টে দিয়েছে। তবে ভাবনায় যদি বিশ্বকাপ থাকে, তাহলে ম্যাচ জেতা লাগবে ঐ বড় দলগুলোর বিপক্ষেই।

হ্যাঁ। মাত্র ৯ টা ম্যাচ। স্যাম্পল সাইজ বেশ ছোট। তারপরও এই চিত্র এটাই প্রমাণ করে যে, জনশ্রুতি কিংবা পরিসংখ্যানের আলোয় তামিম সফল অধিনায়ক বলে যে একটা মিথ তৈরি হয়ে উঠেছে, তা অন্তত পুরোপুরি সত্য নয়। সফলতার আড়ালে তাঁর অধিনায়কত্বে ব্যর্থতাও রয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তামিমের অধিনায়কত্বের পরিসংখ্যান নিয়ে এত কাঁটাছেড়া কেন? বেস্ট দ্যান বেটার বলে একটি কথা রয়েছে। তামিম বেটার অধিনায়ক। তবে কি বেস্ট হওয়ার মতো অধিনায়ক দলে আর কেউ আছে? অনেকেই সাকিব আল হাসানের নামটিই এগিয়ে নিয়ে আসবেন। সদ্য শেষ হওয়া টি-টোয়েন্টি সিরিজে তাঁর নেতৃত্বেই ইংলিশদের হোয়াইট ওয়াশ করেছে বাংলাদেশ।

এটা নিয়ে দ্বিমত থাকার প্রশ্নই ওঠে না, ক্রিকেটীয় ভাবনা কিংবা অভিজ্ঞতায় তামিমের চেয়ে ঢের এগিয়ে সাকিব আল হাসান। এই এগিয়ে থাকাটা সাকিবের অধিনায়কত্বের অভিজ্ঞতা দিয়েই।

সদ্য শেষ হওয়া বিপিএলে তামিম ইকবাল তাঁর দলের অধিনায়কত্বই নেননি। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট বলে সেটাকে উড়িয়ে দেওয়া যেতেই পারে। তবে যে দলে তিনি আইকন খেলোয়াড়, দলে নেই তেমন কোনো নামী খেলোয়াড়। সেখানে নিজে কেন নেতৃত্ব নিলেন না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

তামিম যে যুক্তি হিসেবে তরুণদের নেতৃত্বের কথা বলেছিলেন, তাতে বরং দলের বুমেরাংই হয়েছিল। তাঁর দল খুলনা টাইগার্স বিপিএল শেষ করেছিল প্রায় তলানিতে থেকেই। সাকিব ঠিক এ সব ক্ষেত্রেই মানসিকতা কিংবা ভাবনায় এগিয়ে। তামিম হয়তো জাতীয় দলকে নিয়ে প্রচুর ভাবেন, নির্দিষ্ট করে পরিকল্পনা সাজান। তবে মানসিকভাবে তিনি নিজে কতটা দৃঢ় থাকেন সেটা বড় ধরনের একটা প্রশ্নের জায়গা তৈরি করে।

কারণ বড় রানের লক্ষ্য কিংবা বড় দলের বিপক্ষে নিজের ইনিংসটা ইদানিং বড়ই করতে পারছেন না এ ব্যাটার। সেটা অধিনায়কত্বের চাপ নাকি সাময়িক ব্যাডপ্যাচ তা অজানা। তবে পরিসংখ্যান বলছে, অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর তাঁর ব্যাটিংয়ের চিত্রটা আহামরি তেমন কিছু নয়।

এ দিক দিয়ে সাকিবের ক্ষেত্রে এমন চাপ অবশ্য প্রভাবিতই করেনা। সাকিব নিজেও হয়তো সেটি নিয়ে খুব একটা চিন্তিত থাকেন না। এই নির্ভারতাই সাকিবকে শেষ সিরিজে সফলতা এনে দিয়েছে।

এটা আবারো যুক্ত করতেই হয়, দলে অধিনায়ক হওয়ার দৌড়ে তামিমের চেয়ে এই মুহূর্তে ভাল অপশন আছে। পাশাপাশি এটাও সত্য যে, তামিমের অধিনায়কত্ব কেঁড়ে নেওয়ার মতোও পরিস্থিতিও এখনো তৈরি হয়নি। এমন কিছু হলে সেটা তামিমের জন্য অনেকটা অবিচারই হবে।

তবে তামিমের অধিনায়কত্ব দীর্ঘ মেয়াদে অগ্রসর হবে কিনা, তার একটা সম্ভাবনা নিশ্চিতভাবেই তৈরি হয়ে যাবে ভারতে অনুষ্ঠিতব্য ওয়ানডে বিশ্বকাপের পরে। তামিমের ভাগ্যবদল হতে পারে এই এক বিশ্বকাপ দিয়েই।

কখনোই কোনো ওয়ানডে বিশ্বকাপে ভাল করতে পারেননি তামিম। পঞ্চমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলবেন। তবে এবার নিজের পারফর্ম্যান্স সহ সামলাতে হবে গোটা দলকে। এমন অসম চাপ সামলাতে পারবেন তো তামিম?

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...