এক নি:সঙ্গ যোদ্ধা

চট্টগ্রাম টেস্টে অবশ্য কেবল শিল্পী লিটনকে দেখলাম না আমরা। দেখলাম, এক নি:সঙ্গ যোদ্ধাকেও। প্রথম ইনিংসে তবু তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিম ছিলেন উইকেটে। দ্বিতীয় ইনিংসে প্রায় কাউকেই সাথে পেলেন না। যা একটু লড়াই করার, একাই করে গেলেন।

ইয়ান বিশপ বলেছিলেন, ‘সে যখন ব্যাট করে, মনে হয় মোনালিসার মতো কোনো চিত্রকর্ম দেখছি।’

বিশপ পণ্ডিত মানুষ। তার মত চোখ তো আমাদের নেই। তারপরও এই পাপী চোখে আমরা দেখতে পাই, তিনি সত্যিই এক অসামান্য শিল্পীর মত ছবি একে চলেছেন বাইশ গজে। কখনো চোখ জুড়ানো এক ফ্লিক, কখনো মনোমুগ্ধকর এক কাভার ড্রাইভ; যেন এক শিল্পীর তুলিতে আচড় পড়ে। শিল্পী হয়ে ওঠেন লিটন কুমার দাস।

এই চট্টগ্রাম টেস্টে অবশ্য কেবল শিল্পী লিটনকে দেখলাম না আমরা। দেখলাম, এক নিঃসঙ্গ যোদ্ধাকেও। প্রথম ইনিংসে তবু তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিম ছিলেন উইকেটে। দ্বিতীয় ইনিংসে প্রায় কাউকেই সাথে পেলেন না। যা একটু লড়াই করার, একাই করে গেলেন।

শেষ পর্যন্ত লিটনের এই লড়াই, এই শিল্প; এ সবই অর্থহীন হয়ে গেলো। বাংলাদেশ ম্যাচটাতে চলে গেলো হারের দুয়ারে। তারপরও তুলির আচড়গুলো অন্তত থেকে গেলো।

লিটনের এই বছরটা ছিলো মুদ্রার দুই পিঠ দেখে ফেলার বছর।

একদিকে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে খুব বাজে ফর্ম। সেই বাজে ফর্মের রেশ ধরে টি-টোয়েন্টি দল থেকে বাদ পড়া, ট্রলের পাত্র হওয়া, ঘৃণার শিকার হওয়া; সবই দেখেছেন। বিপরীতে টেস্টে আবার সেই লিটনই আছেন অস্বাভাবিক ফর্মে।

গত বছরে করোনায় খেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ফিফটি করে শুরু করেছিলেন। এরপর করোনা আক্রান্ত এই বিশ্বে একটা বছরে শীর্ষ রান সংগ্রাহকদের মধ্যে চলে এসেছেন। এই বছরে ৬ ম্যাচে ৫৪৩ রান করেছেন ৫৪.৩০ গড়ে। কমপক্ষে বছরে ৫টি ম্যাচ খেলেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তার গড় তৃতীয় সেরা। ওপরে আছেন কেবল জো রুট ও করুনারত্নে।

এই বছরে ৫টি ফিফটি ও একটি সেঞ্চুরি আছে তার। এর মধ্যে ৯৫ রানের ইনিংসও আছে।

এই বছরে একটা জায়গায় লিটন আরও এগিয়ে। এ বছর লিটনের করা ৫৪৩ রান কিপার ব্যাটসম্যানদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। প্রথম অবস্থানে আছেন রিশভ পান্ট। আর কিপার ব্যাটসম্যানদের মধ্যে গড়ের দিক থেকে বছরের সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন তিনি।

এই বছরের শেষ টেস্টে বাকীদের আরও পেছনে ফেলে দিলেন লিটন। দুই ইনিংসে ১১৪ ও ৫৯ রান করলেন। আর সে দুটো ইনিংস খেললেন কী অসাধারণ দু:সময়ে এসে। দু বারই উইকেটে এসে দেখেছেন ৪-এর বেশি উইকেট পড়ে গেছে।

প্রথম ইনিংসে ৪ উইকেট পতনের পর উইকেটে এসে মুশফিককে নিয়ে দলকে টেনে তুলেছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে যখন উইকেটে এলেন, তখন ৫ উইকেট পড়ে গেছে। সেখান থেকে প্রথমে ইয়াসির আলী রাব্বির সাথে একটা চেষ্টা করেছিলেন। রাব্বি আহত হয়ে ম্যাচ থেকেই ছিটকে গেলেন। এরপর আর কেউ দাড়াতেই পারলেন না। ফলে একা একাই লড়ে গেলেন লিটন।

শেষ পর্যন্ত এই লড়াই তাকে নায়ক বানাতে পারলো না। ট্রাজেডিতেই লেখা থাকবে তার নাম। পরাজিত সৈনিককে কে আর মনে রাখে। কিন্তু সংগ্রামের ইতিহাস তাকে একটু হলেও মনে রাখবে একজন সৈনিক হিসেবে। শিল্পের ইতিহাস একটু হলেও তাকে মনে রাখবে একজন শিল্পী হিসেবে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...