অধারাবাহিকতায় হারানো ‘সুন্দর’ প্রতিভা

১৯৯৯ থেকে ২০০১ সাল - নতুন শতাব্দিতে প্রবেশের সময়টাতে বেশ অস্থির একটা সময় পার করছিল ভারতীয় ক্রিকেট। যদিও ইতিহাসে আছে সেটা ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের স্বর্ণযুগ, তবুও তাতে আড়াল করা যায়নি নানা চাপান-উতোর। ম্যাচ ফিক্সিং, দলীয় কোন্দলের সাথে যুঝবার পাশাপাশি ভারতীয় ক্রিকেট দল খুঁজছিল একজন আদর্শ টেস্ট ওপেনার এবং উইকেটরক্ষক ব্যাটারকে।

১৯৯৯ থেকে ২০০১ সাল – নতুন শতাব্দিতে প্রবেশের সময়টাতে বেশ অস্থির একটা সময় পার করছিল ভারতীয় ক্রিকেট। যদিও ইতিহাসে আছে সেটা ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের স্বর্ণযুগ, তবুও তাতে আড়াল করা যায়নি নানা চাপান-উতোর। ম্যাচ ফিক্সিং, দলীয় কোন্দলের সাথে যুঝবার পাশাপাশি ভারতীয় ক্রিকেট দল খুঁজছিল একজন আদর্শ টেস্ট ওপেনার এবং উইকেটরক্ষক ব্যাটারকে। 

অনেককেই চেষ্টা করা হয়েছিল, কেউ শুরুতেই ব্যর্থ বলে বিবেচিত হন, আবার কেউবা প্রমাণ করতে পেরেছিলেন তাঁদের উপর বাজি ধরা যায়। তাঁদেরই একজন ছিলেন ওড়িশার শিবসুন্দর দাস, ধারাবাহিকতার অভাবে যার ক্যারিয়ার শেষ হয়েছে প্রস্ফুটিত হবার আগেই।

ওড়িশা থেকে খুব বেশি ক্রিকেটার উঠে আসেনি ভারতীয় ক্রিকেট আঙিনায়। অন্যান্য রাজ্য যেমন, দিল্লী, মুম্বাই, ব্যাঙ্গালুরুর মত ক্রিকেট স্টেডিয়াম, ক্রিকেট অ্যাকাডেমি কিংবা অনুশীলনের আধুনিক সুযোগ সুবিধাও নেই এই রাজ্যে। বলা চলে ভারতের পশ্চাৎপদ ক্রিকেট রাজ্যের একটি ওড়িশা।  শিবসুন্দরের আগে কেবল দেবাশিষ মোহান্তিই সুযোগ পেয়েছিলেন জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করবার।

তাঁরা দুজনেই ছিলেন আবার খানিকটা সমসাময়িক, শিবসুন্দরের মাত্র এক বছর আগে জাতীয় দলে অভিষেক মোহান্তির। ফলে শিবসুন্দর তাই কাউকে অনুসরণ করবার জন্য পাননি রাজ্যদলে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে রাজ্যের বয়সভিত্তিক দলে সুযোগ পাওয়ার মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে অভিষেক তাঁর। 

রঞ্জি ট্রফিতে ওড়িশা তখন খুঁজছিল ভরসা করার মত একজন ওপেনার। ফলে মাত্র ১৭ বছর বয়সেই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তাঁর, প্রথম ম্যাচেই মধ্যপ্রদেশের বিপক্ষে ৯৮ রান করে জানান দেন নিজের সামর্থ্যের। ওড়িশার পেয়ে যায় তাঁর গর্বের সন্তানকে, পরের দুই দশকে যাকে আগলে রেখেছে পরম মমতায়। সুনীল গাভাস্কারকে আদর্শ মেনে বড় হওয়া শিবসুন্দর ছিলেন আদর্শ টেস্ট ঘরানার ব্যাটসম্যান।

উইকেটে সময় কাটিয়ে ক্রিকেটের ব্যাকরণ মেনেই রান তোলাতেই ছিল তাঁর আগ্রহ। ২০০০ সালে বোর্ডার-গাভাস্কার স্কলারশিপ পান এবং সুযোগ মেলে অস্ট্রেলিয়াতে গিয়ে ক্রিকেট শেখার। সেখানেই নিজের শট খেলার দক্ষতার পূর্ণ বিকাশ ঘটে তাঁর। ফ্রন্ট ফুটে তিনি বরাবরই ভাল ছিলেন পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া গিয়ে উন্নতি আনেন ব্যাকফুটে শট খেলাতেও। 

১৯৯৯-২০০০ মৌসুমে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রায় ৫০ গড়ে সংগ্রহ করেন ৭৯৯ রান। বুচি বাবু ক্রিকেট টুর্নামেন্টে কর্ণাটকের বিপক্ষে খেলেন ১৮৪ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। সেই ম্যাচের পরই মূলত জাতীয় দলের জন্য নির্বাচকদের গুডবুকে আসেন তিনি। ততদিনে ওপেনিং পজিশনে ছয় জন ক্রিকেটারকে বাজিয়ে দেখেছেন তাঁরা, আস্থার প্রতিদান দিতে পারেননি কেউই। অবশেষে সপ্তম ওপেনার হিসেবে বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে সুন্দরেরও অভিষেক হয়ে যায় জাতীয় দলের হয়ে। 

দারুণ ফুটওয়ার্ক আর টেকনিকের অধিকারী সুন্দরকে দেখে সবাই ভেবেছিল অবশেষে ভারত খুঁজে পেয়েছে পরম আরাধ্য ওপেনারকে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দুর্দান্ত ব্যাটিং করে সেই আস্থার প্রতিদানও দিয়েছিলেন তিনি। মাত্র ছয় ম্যাচে ৬২ গড়ে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তাঁর সংগ্রহ ছিল ৫৬২ রান।

তবে, তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় ইনিংস বোধহয় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নাগপুরে। সেই ম্যাচের আগে সুনীল গাভাস্কার তাঁকে পরামর্শ দেন অফস্ট্যাম্পের পরিবর্তে লেগস্ট্যাম্পে গার্ড নিতে। পরামর্শ মেনে ৮৪ রানের অনবদ্য এক ইনিংস খেলেন তিনি।

তবে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে রান করলেও বড় দলগুলোর বিপক্ষে তিনি ছিলেন চূড়ান্ত-রকম ব্যর্থ। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আট ম্যাচে তাঁর সংগ্রহ মোটে ৩৭৪ রান। সোনালি সময় ফেলে আসা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচে করেন কেবল ১২৪ রান।

লাল বলের ক্রিকেটে রেকর্ডটা তবু সম্মানজনক, সাদা বলের ক্রিকেটে চার ম্যাচে সংগ্রহ মাত্র ৩৯ রান। অন্যদিকে ততদিনে মিডল অর্ডার থেকে ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসছেন বীরেন্দর শেবাগ, যিনি পরবর্তীতে বদলে দিয়েছেন আদর্শ টেস্ট ওপেনারের সংজ্ঞা। ২০০২ সালের ক্যারিবীয় সফরের পরই দল থেকে বাদ পরেন তিনি, পরবর্তীতে আর কখনও ডাক পাননি জাতীয় দলে। মাত্র ২৩ টেস্টেই থমকে যায় তাঁর ক্যারিয়ার।

তবে চার বছর বাদে আরও একবার সম্ভাবনা জাগিয়েছিলেন জাতীয় দলে ফিরবার। রঞ্জি ট্রফিতে জম্মু-কাশ্মীরের বিপক্ষে ৫০০ বল মোকাবেলা করে ৪০ চারের সাহায্যে খেলেন ৩০০ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। বিখ্যাত ক্রিকেট লিখিয়ে পিটার রোব্যাক সেই ইনিংসকে বর্ণনা করেছিলেন এভাবে, ‘এই ট্রিপল সেঞ্চুরিটি তাঁর সারাজীবনের পরিশ্রমের ফসল। এটি শৈশবের স্বপ্ন, বাড়ির পেছনে ঘন্টার পর ঘন্টার অনুশীলন, তাঁর আকাঙ্ক্ষা এবং সামর্থ্যের কথা বলে।’

যদিও সেবার আর সুযোগ মেলেনি জাতীয় দলে। ২০১০ মৌসুমে ওড়িশার বদলে বিদর্ভের হয়ে খেলতে শুরু করেন তিনি। ক্যারিয়ারের ইতি টানেন তাঁদের হয়েই। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দশ হাজারের বেশি রানের মালিক শিবসুন্দর দাস।

বর্তমানে ওড়িশার কোচের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বলার মত অর্জন না থাকলেও, শিবসুন্দর স্মরণীয় হয়ে থাকবেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তাঁর অনবদ্য পারফরম্যান্সের জন্য। বীরেন্দর শেবাগের আবির্ভাবের পূর্বে ভারতের ইনিংসের উদ্বোধনের দায়িত্ব সুচারুরূপে পালনের জন্য।   

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...