এক বাবার নির্ঘুম রাত

ঘুমাতে না পারা ব্যাপারটা নিয়ে বৃদ্ধ ক্লার্কের কোনো আফসোস নেই। কারণ, তার ছেলে একটা দিনের জন্য হলেও ক্যারিবিয়দের সোনালী দিন ফিরিয়ে এনেছে। আর সেটা সেই বাংলাদেশে; যেখানে তার নিজেরও খেলার অভিজ্ঞতা আছে। যে বাংলাদেশকে তিনি নিজেও ভালো বাসেন। 

পশ্চিম ক্যারিবিয়ান সময় রাত ১১.৩০টায় যখন শার্লি ক্লার্ক টিভি চালু করেন, তখন তার ছেলে কাইল মেয়ার্স বাংলাদেশের চট্টগ্রামে ব্যাটিং করছে।

শার্লি ক্লার্ক ততক্ষণই টিভি দেখতে চেয়েছিলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তার ছেলে ব্যাটিং করবেন। ভেবেছিলেন, ছেলে আউট হলেই ঘুমিয়ে পড়বেন। কিন্তু সেই রাতে আর ক্লার্কের ঘুমানো হয়নি। বরং পরের রাতটাও তাকে জেগে থাকতে হচ্ছে ছেলের সেই রাতের ব্যাটিং কীর্তি উদযাপনের জন্য।

ঘুমাতে না পারা ব্যাপারটা নিয়ে বৃদ্ধ ক্লার্কের কোনো আফসোস নেই। কারণ, তার ছেলে একটা দিনের জন্য হলেও ক্যারিবিয়দের সোনালী দিন ফিরিয়ে এনেছে। আর সেটা সেই বাংলাদেশে; যেখানে তার নিজেরও খেলার অভিজ্ঞতা আছে। যে বাংলাদেশকে তিনি নিজেও ভালো বাসেন।

২৮ বছর বয়সী অভিষিক্ত কাইল মেয়ার্স যখন পঞ্চম দিনে চট্টগ্রামে খেলতে নামেন তখন তিনি অপরাজিত ছিলেন ৩৭ রানে। যখন ব্যাটিং করতে নামেন তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রয়োজন ছিলো ২৮৫ রান। যা কিনা প্রায় অসম্ভব ছিলো।

প্রথম ইনিংসে যখন মেয়ার্স ৪০ রানে ফিরে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে ক্লার্ক ভেবেছিলেন মেয়ার্স হয়তো দ্বিতীয় ইনিংসে তিন অঙ্কের ম্যাজিক্যাল ফিগারে পৌছাবেন। কিন্তু ভাবেননি মেয়ার্স ২১০ রানে একটি ইনিংস খেলবেন। যেই ইনিংসের কারণে ওয়েস্ট ইন্ডিজের অবিশ্বাস্য এক জয় এলো। এই জয় টেস্টের পরিসংখ্যানের অনেক রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। মেয়ার্সের অপরাকিত ২১০ রানের ইনিংস অভিষেক টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে সর্ব্বোচ্চ রানের রেকর্ড।

রবিবার ক্লার্কের ফোন সারাদিন বেজেই চলেছিলো। দ্বীপের প্রায় সব মানুষই তাকে ফোন দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছিলো। এমন হয়েছিলো তাকে প্রায় অর্ধেক মানুষের ফোনই কেটে দিতে হয়েছে। কারণ তখন তিনি মেয়ার্সের সাথে কথা বলছিলেন। এটা নিয়ে তিনি কোনো অভিযোগ করেননি।

ক্লার্ক জানান, ‘আমি বিশ্রাম নেয়ার কোনো সময়ই পাই নি। আমার সত্যিই মনে হয় না বিশ্রাম নেয়ার কোনো প্রয়োজন আছে। আমি পরেও ঘুমাতে পারবো।’

মেয়ার্স যখন খেলছিলো এবং দলকে জয়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো তখন ক্লার্কের কান্না পাচ্ছিলো। তিনি তার আবেগকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছিলেন না। এমনকি তিনি বাসায় উৎসবও করতে চেয়েছিলেন। পঞ্চম দিনের খেলা শুরু আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের নতুন দুই তারকার সাথে তার কথা হয়েছিলো।

ক্লার্ক বলেন, ‘আমি তাদেরকে শুধু খেলতে বলেছি। বলের দিকে লক্ষ্য রেখো। আর ম্যাচের অবস্থা মাথায় রেখো। আর আমি বিশ্বাস করি তারা ভালো খেলেছে।’

ক্লার্কের জন্য এটা প্রথমবার না। এর আগেও অনেকবার ছেলের খেলা দেখার জন্য রাত জেগেছিলেন তিনি। এর আগেরবারের রাত জাগাটা তার জন্য ছিলো এক দূর্বিষহ ঘটনা। ২০১৭ সালে যখন বার্বাডোজের ডোমিনিকা সফরে ছিলেন। তখন হ্যারিকেন তাদের বাড়ি-ঘর নষ্ট করে দেয়।

ক্লার্ক জানান, ‘ওহ.! এটা খারাপ একটা সময় ছিলো। দুই দিন ধরে তার সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। এমনি কি বার্বাডোজের পুলিশ এবং কোস্ট গার্ড তাকে খুঁজতেছিলো। আমরা ওই সময়ে ঘুমাতে পারি নাই। ওই সময়টা ছিলো খুবই দুঃশ্চিন্তার।’

দূর্ভাগ্যজনক একটি গল্প আছে মেয়ার্সকে নিয়ে। হ্যারিকেনের সময় তিনি তার রুমমেটে সাথে ছিলেন যিনি একজন জ্যামাইকান। কোস্ট গার্ড সদস্যরা তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু তিনি ফিরে যাননি।

চট্টগ্রামেও এক জাম্যাইকানের সাথে এই রেকর্ড গড়েন কাইল মেয়ার্স। তিনিও ছিলেন এক অভিষিক্ত। নাম নিকরুমাহ বোনার। বোনারের সাথে গড়ে তোলেন  রেকর্ড ২১৬ রানে জুটি। আর এই জুটিই গড়ে দেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজেত জয়ের ভিত। এশিয়াতে এর আগে কখনোই কোনো দল এতো রান রান তাড়ায় ম্যাচ জিততে পারেনি। মেয়ার্স অভিষেকে চতুর্থ ইনিংসে দ্বিশতক হাকানো দ্বিতীয় ক্রিকেটার। এর আগে এই রেকর্ড গড়েছেন তারই স্বদেশী গর্ডন গ্রিনিজ।

কাইল মেয়ার্সের  বাল্যজীবনের ক্রিকেট শুরু গ্রিনিজের ওপেনিং পার্টনার ডেসমন্ড হ্যায়েন্সের ক্রিকেট একাডেমিতে। চট্টগ্রামে মেয়ার্স দ্বিতীয় ক্রিকেটার যিনি কিনা এসেছেন কার্লটন ক্রিকেট একাডেমি থেকে। এর আগে এই একাডেমি থেকে জাতীয় দলে খেলেছিলেন ডেসমন্ড হ্যায়েন্স।

ক্লার্কও একই ক্লাবের হয়ে খেলেছিলেন। তিনি স্মরণ করেন তিনি কাইল মেয়ার্সের শাথেও দুই ম্যাচ খেলেছিলেন। ক্লার্ক দেখেন কাইল মেয়ার্সের জাতীয় দলে খেলার মত প্রতিভা আছে।

ক্লার্ক জানান, ‘আমার ছোটো ভাই টনি ক্লার্ক প্রথম বারের মত মেয়ার্সের প্রতিভা দেখেন। ক্রিকেট আমার ছেলের রক্তে মিশে আছে। আমরা যখন ক্রিকেট খেলতো তখন কাইল আমাদের সাথে থাকতো। কাইল যখন স্কুল ক্রিকেট খেলতো তখন থেকেই টেরি তাকে বড়দের খেলায় তাকে নিয়ে আসতো। ব্যাক পাঞ্চ শট খেলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন মেয়ার্স।’

ক্লার্ক মেয়ার্সের খেলা দেখে খুব বেশি আশ্চর্য হননি। যখন মেয়ার্স ক্রিজে ছিলো তখন সবাই তার উপর সবাই তাকিয়ে ছিলো। তিনি জানান ক্যারিয়ারের সঠিক পথে ছিলেন মেয়ার্স।

যখন মেয়ার্স শতক পার করেন তখন তিনি খুব আবেগী পড়েন। তার পুত্র এতো ভালো খেলতে পারে। সে যে চাপে পড়েছিলো,আর চাপের মধ্যে সে যে ছক্কা মেরেছে তাতে সে খুব একটা অবাক হননি। তিনি বিশ্বাস করেন ছক্কা মারা মেয়ার্সের শক্তির একটি জায়গা।

চট্টগ্রামে ব্যাট হাতে ভালো করার পরও একটা আশ্চর্যজনক দিক ছিলো। কয়েক বছর আগেও মেয়ার্সকে বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যান হিসেবে ধারণা করা হয়নি। তাকে বিবেচনা করা হত পেসিং অলরাউন্ডারে হিসেবে। ২০১৮ সালের ইনজুরি তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সে পরিণত হয় একজন ব্যাটসম্যানে।

ক্লার্ক জানান, ‘যেহেতু সে ইনজুরির কারণে বোলিং করতে পারেননি তাই সে ব্যাটিং মনোনিবেশ করা শুরু করেন। এর ফলে ব্যাটিং এ তার উন্নতি বেশ চোখে পড়ে। নরওয়েতে একটি লিগে পর পর দুই সেঞ্চুরি করেন। এর পর আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।’

নরওয়েতে ওই টুর্নামেন্টে ৬ ম্যাচে করেন ৫২৮ রান। গড় ছিলো ১০৫.৬।  এই টুর্নামেন্টে কিছু পাকিস্থানী ক্রিকেটারও খেলেন। তাদেরকে ছাড়িয়ে ভালো খেলেন কাইল মেয়ার্স। যেখানে তার সর্ব্বোচ্চ ইনিংস ছিলো ১৫৮ রানের। ক্লার্ক জানান এই টুর্নামেন্ট তার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে।

জাতীয় দলের সু্যোগ পাওয়ার আগে নিজের শেষ মৌসুমে প্রায় ৫০.৩০ গড়ে রান করেছিলেন। ঘরোয়া টুর্নামেন্টে বাবার পথ অনুসরণ করেন কাইল মেয়ার্স। কাইল এবং ক্লার্ক দুইজনই ওয়েস্ট ইন্ডিজের অনুর্দ্ধ ১৯ দলকে প্রতিনিধিত্ব করেন।

ক্লার্ক বিভিন্ন সময়ে সারওয়ান, ওয়াভেল হিন্ডসদের মত ক্রিকেটারদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। মেয়ার্স তার পরিবারের প্রথম কোনো ক্রিকেটার হিসেবে বাংলাদেশে আসেননি।

ক্লার্ক জানান, ‘১৯৯৫ সালে অনুর্দ্ধ ১৯ দলের হয়ে পাকিস্থান এবং বাংলাদেশ সফরে আসেন তিনি। আমরা ঢাকাতে জাতীয় স্টেডিয়ামে খেলেছিলাম। আর সেই খেলা দেখতে ৩০,০০০ মানুষ খেলা দেখতে আসে। জুনিয়র লেভেলের সেই খেলা দেখতে এতো মানুষ আসে এটা দেখে আমি অবাক হয়েছি। আমি এর আগে কখনো এতো মানুষের সামনে ক্রিকেট খেলি নাই।’

ভাগ্যক্রমে ২৬ বছর পর বাংলাদেশে মেয়ার্স তার একটি সুখস্মৃতি তৈরি করেছে। ক্লার্ক আশা করেননা তার ছেলে তার খেলার ধরন পরিবর্তন করুন।

ক্লার্ক জানান, ‘আমার দেখা মতে কাইল অনেক ইতিবাচক ব্যক্তি। পাশাপাশি সে অনেক নম্র। ও ক্রিকেট সম্পর্কে জানতে খুবই আগ্রহী। সে সবার সাথে খুবই বন্ধুত্ব পূর্ণ।  আমি আশা করি তার এই অর্জন তার বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক নষ্ট করবে।’

১৯৯০ সালের দিকে দিকে বার্বাডোসের অনেকেই ভাবতো ক্লার্ক বড় পর্যায়ে যেতে পারতেন।

ক্লার্ক বলেন, ‘এটি তার সময়। এটি তার ক্যারিয়ার। এটি তার সম্পর্কেই হওয়া উচিত।’

আপাতত ক্লার্ক অনেক ফোন কলের অপেক্ষায় আছেন। কাইল আসলে অনেক উৎযাপণের অপেক্ষায় আছেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...