Social Media

Light
Dark

একজন ‘সম্ভাব্য’ ব্র্যাডম্যান

সাল ১৯৩৮। খেলা চলছে ইংল্যান্ডের ট্রেন্ট ব্রিজে। অ্যাশেজ সিরিজের প্রথম টেস্ট। তিনি ব্যাট করছেন ২০০’র কাছাকাছি রানে। বল করছেন এসেক্স তথা ইংল্যান্ডের জোরে বোলার কেন ফার্নেস। লেগস্ট্যাম্পের ওপর একটা মোটামুটি বল করলেন। সাধারণ ব্যাটসম্যান হলে বড় জোর স্কোয়ার লেগে ঠেলে এক বা দুই নেবেন।

বড় ব্যাটসম্যান হলে ফ্লিক করে বড়জোর চার পাবেন। তিনি অফের দিকে সরে গিয়ে স্কোয়ার লেগের ওপর দিয়ে সোজা বলটি উড়িয়ে দিলেন। তখন এত বাক্স-বাক্স বল মজুদ থাকতো না আন্তর্জাতিক ম্যাচেও। কাজেই বলটি ফিরিয়ে আনতে সময় লাগবে। ফার্নেস সেই ফাঁকে নন-স্ট্রাইকার প্রান্তে দাঁড়ানো বিল ওরিলি কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘একে কি বল করবো বলো তো?’

ওরিলির রসবোধ মোটামুটি সর্বজনবিদিত। তিনি বললেন, ‘তুমি বরং গিয়ে ওর অটোগ্রাফ নিয়ে এসো।’ এখানে তিনি হলেন স্ট্যান ম্যাককেব। খেলেছেন মাত্র ৩৯ টেস্ট। ৪৮ গড়ে আড়াই হাজারের কিছু বেশি রান করেছিলেন। কিন্তু তাও তাঁর প্রভাব এমনই যে সতীর্থ থেকে বিপক্ষ, সকলেই সমান ভাবে শ্রদ্ধা করতেন ম্যাকেবকে।

নেভিল কার্ডাস লিখেছেন, ‘ট্রাম্পারের অসি ও বর্ম নিয়ে ফিরে এসেছেন ম্যাককেব।’ আরেক সুবিখ্যাত ইংরেজ লেখক ই ডাব্লিউ স্যান্টোন লিখেছেন, ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ বা পারফেক্ট ক্রিকেটার বলে যদি কিছু থেকে থাকে, ম্যাককেব তার খুব কাছাকাছি কিছু ছিলেন।’

দীর্ঘদিনের সতীর্থ ক্লেরি গ্রিমেট মনে করতেন, ব্র্যাডম্যানের চেয়েও ভালো তাঁর টেকনিক। হাটন তো বলেইছিলেন, ‘ম্যাককেব ছাড়া আমি অন্য কাউকে অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান ভাবতে পারবো না।’ ওই সময় অস্ট্রেলিয়া দলে ব্র্যাডম্যানের পরই দ্বিতীয় সেরা ছিলেন ম্যাককেব।

হার্বার্ট সাটক্লিফকে মুগ্ধ করেছিল তাঁর খেলোয়াড়োচিত মনোভাব বা স্পিরিট অফ ক্রিকেট মেনে খেলার ধরণ। মতি নন্দী কোথাও লিখেছিলেন, ‘ক্রিকেট খেলে দুই প্রকার ব্যাটসম্যান, এক যারা ছুঁতোর আর দুই যারা শিল্পী।’ সংক্ষেপে বললে, ম্যাককেব ছিলেন শিল্পী। ট্রেন্টব্রিজের সেই ২৩২ দেখে ব্রাডম্যান স্বয়ং সতীর্থদের বলেন, ‘যা দেখছো, দু চোখ ভোরে দেখে নাও – এই সুযোগ আর পাবে না। এমন ইনিংস খেললে আমিও নিজেকে নিয়ে গর্ব করতাম।’

৬৫০ রানের চাপ মাথায় নিয়ে ব্যাট করে ট্রেন্টব্রিজের সেই ২৩২ ম্যাকেব জীবনের শেষ সিরিজে খেলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে সম্ভবত প্রথম সরাসরি সম্প্রচারিত ১৯৩৮ এর ওভাল টেস্ট, যেখানে লেন হাটন ৩৬৪ করেন, সেটাই ছিল মাকেবের শেষ টেস্ট। মাত্র ২৭ বছর বয়সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পায়ের অসুবিধা তালা মেরে দেয় তাঁর ক্রিকেট জীবনে। মাত্র ৩৯ টেস্টেই থেমে যান তিনি।

যে ইনিংস স্ট্যান ম্যাককেব কে গোটা ক্রিকেট বিশ্বের সম্ভ্রমের পাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, সেটার কথা না বললে ম্যাককেব উপাখ্যান অপূর্ণ রয়ে যায়। সিডনিতে কুখ্যাত বডিলাইন সিরিজের প্রথম টেস্ট চলছে। ততদিনে মাত্র ১৫ টেস্ট খেলেছেন ম্যাককেব। একটিও সেঞ্চুরি নেই। তখনকার দিনে বুকি বা উগ্রপন্থী শব্দ দুটো এতই অপরিচিত ছিল যে, ঘরের মাঠে খেলা হলে খেলোয়াড়রা নিজের মা বাবার সাথেই বসতে পারতেন ব্যাটিং বা বোলিংয়ের ফাঁকে। ম্যাককেব সেরকমই বসে ছিলেন।

ভালো উইকেটে উডফুল, পন্সফোর্ড এবং ফিঙ্গেলটনের পরে নামবেন ম্যাকেব। কাজেই মা বাবার সাথে বেশ কিছুক্ষন সময় কাটানোর অবকাশ ছিল ম্যাককেবের। কিন্তু তিনি জানবেন কিভাবে যে ইংরেজ অধিনায়ক জার্ডিন, লারউড এবং ভোস কে দিয়ে বডিলাইনের নীতি অবলম্বন করবেন। নীতিটি ব্র্যাডম্যানকে থামানোর জন্যে ছিলো। ব্র্র্যাডম্যান সেই টেস্ট খেলেননি (সম্ভবত) চুক্তি জনিত কারণে। কিন্তু তাতে কি? ব্র্যাডম্যান ফেরার আগে একবার বডিলাইনের ড্রেস-রিহার্সাল তো দেয়াই যায়।

৮২ রানে তিন উইকেট নেই। এই অবস্থায় স্ট্যান ম্যাককেব প্যাড পড়তে পড়তে বাবাকে বললেন, ‘মাঠে আমার গায়ে বা মাথায় বল লাগলে যেন মা আবার দৌড়ে না মাঠে ঢুকে পড়েন।’ তা মাকে আর মাঠে ঢুকতে হয়নি। তিনি মেম্বার প্যাভিলিয়নে বসে এরপর এক অনন্য ব্যাটসম্যানশিপের প্রদর্শনী প্রতক্ষ্য করেন।

পুল এবং হুক, মূলত এই দুটি শট অসামান্য ফুটওয়ার্ক এবং দক্ষতার সাথে খেলেন ম্যাকেব। তখনকার দিনে বলের হিসেবে রাখা হতো না, কিন্তু ক্রিকইনফো খুলে দেখা গেলো সেই টেস্টে বলের হিসেব রাখা হয়। ২৩৩ বলে ১৮৭ রান করে নট আউট রয়ে যান ম্যাকেব। তিনি যে সময় ক্রিজে ছিলেন, সেই সময় যে ২৭৮ রান ওঠে তার মধ্যে ৬৭.৩% রান ছিল ম্যাকেবের।

চ্যাপেলদের দাদু ভিক্টর রিচার্ডসন এর ৪৯ ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। মূলত ম্যাকেবের সৌজন্যেই অস্ট্রেলিয়া তোলে ৩৬০। যদিও অস্ট্রেলিয়া টেস্টটি ১০ উইকেটে হেরে যায়, কিন্তু বডিলাইনের বিরুদ্ধে এই নান্দনিক বিক্রম এখনো সকলে মনে রেখেছেন।

ম্যাককেব ও ব্র্যাডম্যান

শেষ করি একটা ছোট্ট ঘটনা বলে। ম্যাককেবের বীরত্বের পরদিন সিডনির কাগজ গুলো উচ্ছসিত প্রশংসা করে ম্যাকেবের। নির্বাচক প্রধান এরপর ম্যাককেবকে জিজ্ঞেস করেন, ‘এত প্রশংসা পড়ে মাথা ব্যাথা করছে তো?’ ম্যাককেব ছোট্ট উত্তর দেন, ‘আমি পড়িনি। কারণ জানি ওরা অনেক বাড়িয়ে লিখেছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link