সাবিত্রী আর অর্চনা, দুই দেবীর গল্প

গল্পটা এক মায়ের। ভারতের হয়ে এবারের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলা অর্চনা দেবীর মা সাবিত্রী দেবীর জীবন সংগ্রামের গল্প। 

ক্যান্সারে প্রথমে স্বামীর বিদায়, এরপর সাপের কামড়ে ছোট ছেলেও মারা গেল। দুর্বিষহ জীবনের শুরুটা সেখানেই। তারপরও অনেক ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে আরো দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে এগিয়ে চললেন। তিল তিল করে গড়ে তুললেন তাদের।

গল্পটা এক মায়ের। ভারতের হয়ে এবারের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলা অর্চনা দেবীর মা সাবিত্রী দেবীর জীবন সংগ্রামের গল্প।

ভারতের উন্নাউ প্রদেশের প্রত্যন্ত এক অঞ্চল গঞ্জ মুরাদাবাদ। কুসংস্কার মেনে চলা যেখানকার মানুষের নিত্যদিনের চিত্র। সাবিত্রী দেবীর বেলাতেও তাই হল। ২০০৮ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তাঁর স্বামী পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। স্বামী হারিয়েছেন।  আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সমবেদনা তো দূরে থাক জুটলো ধিক্কার। যত্নের অভাবেই স্বামী মরেছে, এমন শোরগোলে ‘ডাইনী’ বনে চলে গেলেন সাবিত্রী দেবী।

নিজে বেশিদূর পড়াশোনা করেননি। কিন্তু সন্তানদের শিক্ষিত করতে চাইলেন প্রবলভাবে। মেয়ে অর্চনা দেবীকে ভর্তি করালেন গ্রাম থেমে ১৫/২০ কিলোমিটার দূরের এক ভাল স্কুলে। এখানেও কুসংস্কার। মেয়ে মানুষকে কেন এত দূরে গিয়ে পড়াতে হবে! এ নিশ্চিত ডাইনি। এলাকার মানুষদের কাছে ডাইনি পরিবার নামে পরিচিত হতে থাকল সাবিত্রী দেবীরা।

প্রতিবেশীদের ধিক্কারের তীব্রতা আবারো বাড়লো প্রায় বছর দশ বছর পর। ২০১৭ সালে সাবিত্রী দেবীর ছোট ছেলে বুদ্ধিমান সিং সাপের কামড়ে মারা গেল। এলাকায় আবারো সাবিত্রী দেবীকে নিয়ে শোরগোল। কুসংস্কারে নিমজ্জিত হয়ে সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করল, এই ডাইনি প্রথমে স্বামীকে খুন করেছে, পরে ঐ পাপে ছেলেটাও মরে গেল।

স্বামী হারানোর পর ছোট ছেলের বিদায়। সাবিত্রী দেবী এখানেই ভেঙে পড়তে পারতেন। কিন্তু, না। তিনি তাঁর বাকি দুই সন্তানকে নিয়ে দূর পথে পা বাড়ালেন। এলাকার মানুষের বদ্ধমূল ধারণাকে তোয়াক্কা না করে এগিয়ে চললেন।

একটি গরু আর একটি মহিষ পালতে শুরু করলেন। দুধ বিক্রি করে সংসার চালাতে শুরু করলেন। অভাব সব সময়ই ছিল। কিন্তু দুই সন্তানের জন্য নিজের লালিত স্বপ্ন কখনও আড়াল হতে দিতেন না।

মায়ের সে সব দু’চোখ ভরা স্বপ্নে সম্ভবত প্রথম আলোর রেখা এনে দিলেন মেয়ে অর্চনা দেবী। অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে এবারের অনূর্ধ্ব-১৯ নারী বিশ্বকাপ জিতেছে ভারত। আর সে ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ দুই উইকেট নিয়ে ম্যাচ জয়ের নেপথ্যের অন্যতম নায়ক ছিলেন এই অর্চনা দেবী।

যে বাড়িকে একটা সময় ডাইনীদের বাড়ি বলা হতো সেই বাড়িই এখন হয়ে উঠেছে আশীর্বাদপুষ্ট বাড়ি। যারা একটা সময় সাবিত্রী দেবীকে ধিক্কার জানিয়েছিলেন, তারাই এখন বাড়িতে এসে শুভকামনা জানাচ্ছেন। তাঁর মেয়েকে নিয়ে গর্ব করছেন। সবটাই মেয়ে অর্চনা দেবীর কল্যাণে।

সাবিত্রী দেবী তাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে সৌভাগ্যবতীদের একজন। মুখ ফিরিয়ে নেওয়া মানুষগুলো আজ তাঁর বাড়িতে ভীড় করছে। তাদের বসতে দেওয়ার মতোও জায়গা করে দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। টেলিভিশনে তাঁর মেয়ের খেলা দেখতে এসে অগণিত লোক জড়ো হচ্ছে এক সময়কার ডাইনী বাড়িতে। সাবিত্রী দেবীর কাছে তাই যেন এখন সুখের অন্ত নেই। মেয়ের অর্জনের এমন একটা দিনের অপেক্ষাতেই তো ছিলেন তিনি।

অর্চনা দেবীর বাইশ গজের ক্রিকেটে আগমনের গল্পে ফেরা যাক। পাড়ায় আগে থেকেই খেলতেন। তবে সর্বপ্রথম নজরে আসেন কোচ পুনম গুপ্তের। অর্চনার বোলিং দেখে বেশ মুগ্ধ হলেন। তাই তাঁর বোলিংয়ের ভিডিও করে রাখলেন তিনি। পুনম গুপ্ত তখন অর্চনা দেবীর স্কুলের ক্রিকেট কোচ ছিলেন। তো গ্রীষ্মের ছুটিতে যখন নিজের বাড়ি কানপুরে গেলেন তখন তিনি যোগাযোগ করলেন কপিল পাণ্ডের সাথে। যিনি আবার ভারতীয় ক্রিকেটার কুলদ্বীপ যাদবের কোচ ছিলেন।

তো পুনম গুপ্ত কপিল পাণ্ডের কাছে অর্চনার কথা বললেন। অর্চনার বোলিংয়ের ভিডিও দেখালেন। ব্যাস। সেখানেই মোড় ঘুরে যায় অর্চনা দেবীর জীবন। কপিল পাণ্ডে অর্চনাকে কানপুরে আসতে বললেন। কানপুর ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনে ভর্তি করালেন। আর এর পরেই বয়স ভিত্তিক ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফর্ম করে সরাসরি ঢুকে পড়লেন অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের দলে।

বিশ্বকাপ দলে যখন সুযোগ পেলেন তখন অর্চনা দেবীর স্বাভাবিক ভাবেই মায়ের কথা প্রথম স্মরণ হয়েছিল। তবে সে সময়টায় তাঁর আরেকটা কথাও কানে বাজছিল। ‘অর্চনা, তুই ক্রিকেট খেলে যাস’। অর্চনার ভাই বুদ্ধিমান সিংয়ের শেষ কথা ছিল এটি। অর্চনা দেবী ক্রিকেট খেলেছেন। ভারতের হয়ে বিশ্বকাপ জিতলেন। কিন্তু তাঁর সেই ভাইটা আর এ পৃথিবীতে নেই।

ক্রিকেটের সাথেই মিশে আছে সেই মন খারাপ করা স্মৃতি। অর্চনা আর বুদ্ধিমান সিং ছোটবেলায় প্রায়ই এক সঙ্গে ঝোপের ঝাড়ে ফাঁকা জায়গায় ক্রিকেট খেলতো। একবার খেলতে গিয়ে অর্চনা বল মারলো ঝোপের দিকে। অর্চনার ভাই সে বল খুঁজতে গিয়ে ঝোপের ভিতর ঢুকে পড়ে। আর সেখানেই ঘটে সর্বনাশ। গোখরার কাপড়ে সেখানেই মারা যায় ছোট ভাই বুদ্ধিমান সিং। বোন অর্চনার কোলেই তাঁর মৃত্যু হয়। অর্চনার সেই স্মৃতি এখনও তাঁকে তাড়া করে বেড়ায়।

তবে সে দুঃসহ স্মৃতিকেই আঁকড়ে ধরে পরবর্তীতে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলে ছিলেন অর্চনা দেবী। ভারতের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলে নিজের ভাগ্য বদলালেন। একই সাথে নিজের মা সাবিত্রী দেবীর বহু বছর ধরে পাওয়া ধিক্কার থেকে মুক্তি দিলেন। অর্চনা দেবীকে নিয়ে এখন তাঁর পাড়ায় মিছিল হয়। মা সাবিত্রী দেবীর জন্য এটাই যেন পরম পাওয়া। মেয়ের বিজয়, মায়েরও বিজয়। মা মেয়ের এমন বিজয়গাঁথায় ধুঁকতে থাকা এক পরিবারের ট্রাজেডিময় অধ্যায়েরও যেন স্থায়ী সমাপ্তি ঘটলো ।

 

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...