সোনায় বাঁধার অন্য ইতিহাস

সেই ট্রফিতে এই কোচেরা হাত ছোঁয়ানোর সুযোগ পাননি। কিন্তু তাঁদের গড়ে দেওয়া হাত কিন্তু ঠিকই ট্রফিটা ছুঁয়েছে! পচেফস্ট্রুমে সেদিন হয়তো ফারুকি, সুদীপ্ত কিংবা আখিনুরের কেউ ছিলেন না কিন্তু আকবর আলীর উঁচিয়ে তোলা ট্রফিতে এদের মত প্রান্তিক পর্যায়ের কোচদের দাবিটাও কিন্তু সেই ট্রফিতে কম নয়!

সময়ের চাহিদা ছিল, পরিস্থিতির ছিল না। সেদিন চাঁদপুরে শামীম ফারুকি নিজের ক্রিকেট অ্যাকাডেমিটা খোলেননি, বন্ধ রেখেছিলেন। কারণ? তাঁরই দুই ছাত্র মাহমুদুল হাসান জয় আর শামিম হোসেন ভারতের বিপক্ষে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে নামছে।

সুদীপ্ত দাসও সেদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে নিজের অফিসে বসে ম্যাচটি দেখা শুরু করেছিলেন। অফিস ছুটির পর ম্যাচের বাকি অংশটুকু নিজের বাসাতে বসেই দেখেছিলেন। সুদীপ্ত দাসের এই কর্মজীবনের বাইরে চাতকের মত ম্যাচ দেখার কারণ শুধুই বাংলাদেশ ফাইনালে খেলছিল বলে নয়, কারণটা শাহাদাত হোসেন। শাহাদাতের বাবা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজেই কাজ করত। বাবার মৃত্যুর পর শাহাদাতের পরিবার চরম অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হয়, একটা সময় শাহাদাত গ্রামে ফিরে যাবেন বলেও ভাবতে শুরু করেন। সেরকমটা হলে হয়তো পচেফস্ট্রুমে লাল সবুজ জার্সি গায়ে তিনি মাঠে নামতে পারতেন না। তা সেরকমটা না হওয়ার কারণই হলেন এই সুদীপ্ত দাস। শাহাদাতের বেড়ে ওঠা এই সুদীপ্তর কাছেই, শাহাদাতের এক রকম অভিভাবকও তিনি।

আখিনুর রহমানও হয়তো টিভির সামনে বসে চার বছর আগে ফিরে দেখছিলেন। কুড়িগ্রাম থেকে এক ফাস্ট বোলারকে তুলে এনে তাকে দীক্ষা দিয়েছিলেন নিজের কোচিংয়ের গুণে। সেই শাহীন আলমও ছিলেন পচেফস্ট্রুমের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে প্রথমবারের মত লাল সবুজের মহত্ত্ব ঘোষণার মিশনে!

ছোট ছোট বালুকণা , বিন্দু বিন্দু জল/ গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল। আমরা সবাই সাগরই দেখি, দেখতে থাকি বালুকাবেলায় বানানো গোটা ভাস্কর্যটা। কিন্তু স্টেজে গিটার হাতে পারফর্ম করা গায়কের পিছেও কেউ থাকে, পর্দার পেছনের সেই মানুষটাকে আর চেনা হয়না আমাদের। উপরে যে অনেকের মধ্যে যে তিনজনের উদাহরণ দিলাম সেই তিনজন হলেন এমন নায়ক। পচেফস্ট্রুমে সেদিন হয়তো রিচার্ড স্টোয়িনিস ছটফটানিতে লাফাচ্ছিলেন, ডাগআউটে বসে জেতার ছক কষছিলেন নাভিদ নেওয়াজ, কিন্তু মাঠে থাকা ক্রিকেটারদের প্রথম হাতেখড়িটা দিয়েছিল তো অন্য কেউ। তাঁদের কেউ ছিল চাঁদপুরে, কেউ চট্টগ্রামে , কেউ দিনাজপুরে কেউ বাংলাদেশের কোন না কোন কোণায়! দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভিততো এরাই গাঁথছেন।

ফারুকি চাঁদপুরে একটা ক্রিকেট অ্যাকাডেমী চালান, নাম ‘ক্লেমন চাঁদপুর ক্রিকেট অ্যাকাডেমি’ । সেই অ্যাকাডেমীতেই ব্যাটিংয়ের বেসিক শিখেছেন মাহমুদুল হাসান, নিউজিল্যান্ডের সাথে যার সেঞ্চুরি না হলে হয়তো বাংলাদেশ ফাইনালেই পৌছাতে পারত না। কিংবা ইয়ন মরগ্যানের রেকর্ড ভেঙে এক পঞ্জিকাবর্ষে যুব ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটাই হয়তো হত না!

ফারুকির আরেক ছাত্র শামীম, মাত্র ১২ বছর বয়সেই যিনি ক্রিকেটটাই ছেড়ে দিতে পারতেন। চট্টগ্রামের মহিলা কমপ্লেক্সে সেবার এক টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। ছোটদের ক্রিকেটে সবাইকে যখন মেডিকেল টেস্ট দিতে ডাকা হল, শামীম নামে সেদিনের ছেলেটা দেখা গেল উচ্চতাতে ন্যূনতম মান অতিক্রম করতে পারছেন না। শামীমের মুখে রাজ্যের মেঘ দেখে ফারুকি তাকে দলে নিয়ে নিলেন। ফারুকি যদি এটা না করতেন তাহলে সেমি-ফাইনালের দুটো উইকেট কে নিত!

এ হিসেবে সুদীপ্ত দাস অবশ্য কোন কোচ নন, তবে স্থানীয় খেলোয়াড় হিসেবে তিনিও তরুণদের সাহায্য করতেন। সুদীপ্ত শাহাদাতকে চিনতেন আগে থেকেই, এমনকি স্থানীয় একটি ক্রিকেট অ্যাকাডেমীতে তিনি শাহাদাতকে তিনি ভর্তির সুযোগ করে দিয়েছিলেন একেবারেই ফ্রি-তে। অবশ্য ইস্পাহানী অ্যাকাডেমীতে ভর্তি করে দেওয়া ছাড়া সুদীপ্তর করার আর কিছুই ছিলেন না, এর বেশি তিনি করতে পারতেন না।

আরো পড়ুন

শাহাদাতের সরঞ্জাম কেনার মত টাকা ছিল না।  ক্রিকেটটা তিনি খেলতেন সুদীপ্তর সরঞ্জাম দিয়েই। সুদীপ্তকে তাই নিজের ক্লাবের ম্যাচ খেলতে নামতে হত ধার করা সরঞ্জাম দিয়েই। এরপর ২০১০ এ যখন শাহাদাতের বাবা মারা যায়, শাহাদাতের ক্রিকেট তখন বন্ধ হবার যোগাড়। সেসময় এই সুদীপ্তই শাহাদাতের মা-কে বোঝালেন, শাহাদাতকে ক্রিকেটটা চালিয়ে যেতে বললেন।

আখিনুর রহমান ২০ বছর বিকেএসপির কোচ ছিলেন, এরপর তাকে বিকেএসপির দিনাজপুর ব্রাঞ্চে পাঠিয়ে দেওয়া হল । সেখানেই কুড়িগ্রামে এক ট্যালেন্ট হান্টে গিয়েছিলেন তিনি উঠতি প্রতিভার খোঁজে। ২০১৬ সালের সে ট্যালেন্ট হান্টে তিনি দেখলেন এখানে আসা সবাই-ই ব্যাটসম্যান, কেউই বোলার হতে চায়না। কিন্তু হঠাৎ তাঁর নজর কাড়ল একটি ছেলে। ১৩-১৫ বছর বয়সের সীমারেখায় ছেলেটা একটু বড়ই ছিল, সাথে আখিনুরের নজর এড়াল না যে ছেলেটার পায়ে কোন জুতা ছিল না।

খালি পায়ে আসা সেই ছেলেটা আখিনুরকে বলল, সে বোলার হতে চায়। আখিনুরের যে প্রথমে বিশ্বাস হয়েছিল তা নয়। কিন্তু শাহীন আলমকে তিনি নিজের জাত চেনানোর একটা সুযোগ দিয়েছিলেন। নেটে পাচ/ছয়টা বল করার পর চোখের সামনে সাকিব,মুশফিককে বেড়ে উঠতে দেখা আখিনুরের পাকা জহুরীর চোখ যা বোঝার বুঝে গেলেন। তিনি শাহী আলমকে সুযোগ দিলেন । শাহীন আলম অবশ্য ফাইনালের একাদশে থাকতে পারেননি, কিন্তু বিশ্বকাপজয়ী স্কোয়াডে থাকাও তো কম কথা নয়! আখিনুরের জহুরী চোখ না থাকলে খালি পায়ে পেস বোলিং ট্রায়াল দিতে আসা শাহীন আলম আজকে কোথায় থাকতেন কে জানে!

এই ‘কে জানে’ র অনিশ্চয়তা ছিলে আজকে টিভি স্ক্রিনে দেখা প্রায় সব ক্রিকেটারেরই।  তা এই অনিশ্চয়তাকে যারা নিশ্চয়তায় মুড়ে দিয়েছিলেন, সেই প্রান্তিক পর্যায়ের কোচেরাই আসলে পর্দার আড়ালের নায়ক।

আমি মাত্র তিনজনের উদাহরণ দিলাম। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া এমন কোচেরা আছেন অনেকে। বাংলাদেশ  প্রথমবারের মত আইসিসির অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ট্রফি জিতেছিল। সেই ট্রফিতে এই কোচেরা হাত ছোঁয়ানোর সুযোগ পাননি। কিন্তু তাঁদের গড়ে দেওয়া হাত কিন্তু ঠিকই ট্রফিটা ছুঁয়েছে! পচেফস্ট্রুমে সেদিন হয়তো ফারুকি, সুদীপ্ত কিংবা আখিনুরের কেউ ছিলেন না কিন্তু আকবর আলীর উঁচিয়ে তোলা ট্রফিতে এদের মত প্রান্তিক পর্যায়ের কোচদের দাবিটাও কিন্তু সেই ট্রফিতে কম নয়!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...