মিডল অর্ডার ও মন খারাপের দায়

বোর্ড অব কনট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া (বিসিসিআই) একটি স্বতন্ত্র সংস্থা এবং সেই সূত্রে তারা কাউকে কোন কৈফিয়ত না দিয়ে তাদের মতো সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। হ্যাঁ, সেখানে জনগনের আবেগ যতই জড়িয়ে থাকুক, তাদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু যেহেতু ক্রিকেট আজ এক বিরাট ব্যবসা, বোর্ড একটা বড় কর্পোরেট সংস্থা ছাড়া কিছুই না, সেখানে দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যাটিং কোচ, মনোবিদ ভিডিও অ্যান্যালিস্ট - এদের অ্যাকাউন্টেবিলিটি নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো কি কেউ নেই?

কপিল দেবের অপরাজিত ১৭৫ বা শারজাতে ওলঙ্গা খ্যাত ম্যাচ বা নিদেনপক্ষে ’৯৯ বিশ্বকাপে গ্রুপ লিগের মহান নাটকীয় ম্যাচ না হলে সাধারণত প্রায় বিশ বছর পরেও সাধারণ ক্রীড়াপ্রেমীর কোন দায় নেই একটা ভারত জিম্বাবুয়ে ম্যাচ মনে রাখার।

এরকমই একটা নিতান্ত সাধারণ টেস্ট ম্যাচ, ২০০২-এর ফেব্রুয়ারিতে। ভারতীয় অধিনায়ক চূড়ান্ত অফফর্মে। সীমিত ওভারে রান আসলেও টেস্টে চলছে লম্বা খরা। শেষ শতরান প্রায় ৪০/৪৫ ইনিংস আগে ’৯৯ এর অক্টোবরে আমেদাবাদে করা ১২৫। মাঝে বলার মতো ইনিংস ক্যান্ডিতে করা ম্যাচ জেতানো অপরাজিত ৯৮ যদিও সেটা কোনমতেই নিখুঁত ইনিংস নয় আর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে করা ৮৪।

এমতাবস্থায় দিল্লী টেস্টের আগে অধিনায়ক গেলেন সহ-অধিনায়কের কাছে, কোচের সম্মতি সহ। আর্জি, একটা টেস্টে তিনি তিনে ব্যাট করবেন এবং রাহুল পাঁচে। রাহুল, দল এবং অধিনায়ক এর স্বার্থে রাজি হয়ে গেলেন আর অধিনায়ক খেলে এলেন ১৩৬ রানের এক ঝকঝকে ইনিংস। আগের ৪৫ ইনিংসে যার একটাও শতরান ছিল না, পরের ৩৫ইনিংসে এল চারটে শতরান (১৩৬ সহ) ও একটা ৯৯।

আর একজনের নাম মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন। ’৯৪-এর শুরুতে দুর্বল শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে করা শতরানের পর ব্যাটে রান নেই। মধ্যিখানে বিশ্বকাপে হার, ব্যক্তিগত জীবনে প্রবল ঝড় ঝাপটা, অধিনায়কত্ব হারানো এবং যে কোন সময়ে দল থেকে বাদ যাওয়ার আশঙ্কা। ততক্ষণে ‘সময়’ পৌঁছে গেছে ’৯৬-এর নভেম্বরে। প্রিয় ইডেনে হাতে চোট পেয়ে ড্রেসিংরুমে চলে গিয়ে কি ভেবেছিলেন সেটা বিধাতা ছাড়া কেউ জানে না।

সামনে ফলো অনের ভ্রুকুটি, দল ১৬০ এ ৭ উইকেট খুইয়ে বসে আছে। এমতাবস্থায় পরের দিন ফিরলেন সম্পূর্ন অন্য মেজাজে। টেস্ট ম্যাচে ১৪১ স্ট্রাইক রেটে শতরান করে মাঠ ছাড়লেন। একেবারে উল্টো ক্রিকেট খেলে। পরের তিন টেস্টের মধ্যে কানপুরে এলো ১৬৩ এবং এলো কেপটাউনের সেই বিখ্যাত শতরান। ফিরে পেলেন নিজেকে, অধিনায়কত্ব এবং আরও তিন চার বছরের ক্রিকেটজীবন। ২০০৩/০৪ এর সিডনির শচীন টেন্ডুলকারের ক্ষেত্রেও অনেকটা একই গল্প কিন্তু তিনি শচীন বলে দলের বাইরে যাওয়া বা অধিনায়কত্ব হারানোর ভয় তাঁর ছিল না।

কিন্ত মূল বিষয়টা এক। এঁরা কেউই ব্যাটসম্যান হিসেবে খারাপ ছিলেন না। রাতারাতি কেউই খারাপ বা ভাল ব্যাটসম্যান হয়ে যাননি। কিন্তু যখন লম্বা ব্যাড প্যাচ চলেছে, সমস্ত ক্রিকেটীয় চেষ্টা চালিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ করে একটা আউট অব দ্য বক্স সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেদের ফিরে পেয়েছেন। এই নমনীয়তাটা তাদের নিজেদের এবং সেই সময়ের দলের মধ্যে সেই সময় ছিল। যেটা আজ নেই।

তা না হলে দীর্ঘদিন ধরে এক আধটা বিক্ষিপ্ত লগ্ন ছাড়া ভারতের সাধের মিডল অর্ডার খারাপ খেলতে খেলতে এটাকে একটা অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও না তারা নিজেরা কিছু ব্যতিক্রমী ভাববেন, না তাদের টিম ম্যানেজমেন্ট।

যারা গড়ে ৮০/৮৫টা করে টেস্ট খেলে ফেলেছে তারা হঠাৎ করে খারাপ ব্যাটসম্যান হয়ে যেতে পারে না। তাদের একটা কোন একটা সমস্যা চলছে এবং সেটা সবার একসঙ্গে। হ্যাঁ, চেতেশ্বর পূজারার ইনিংস সত্ত্বেও এটা লিখছি কারণ, আরও অন্তত দুটো টেস্ট না গেলে বোঝা যাবে না যে সত্যি তিনি অফ ফর্ম কাটিয়ে উঠলেন নাকি একটা জীবনদায়ী ওষুধ খেলেন।

বোর্ড অব কনট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া (বিসিসিআই) একটি স্বতন্ত্র সংস্থা এবং সেই সূত্রে তারা কাউকে কোন কৈফিয়ত না দিয়ে তাদের মতো সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। হ্যাঁ, সেখানে জনগনের আবেগ যতই জড়িয়ে থাকুক, তাদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু যেহেতু ক্রিকেট আজ এক বিরাট ব্যবসা, বোর্ড একটা বড় কর্পোরেট সংস্থা ছাড়া কিছুই না, সেখানে দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যাটিং কোচ, মনোবিদ ভিডিও অ্যান্যালিস্ট – এদের অ্যাকাউন্টেবিলিটি নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো কি কেউ নেই?

তিন তিনজন বিশ্বমানের ব্যাটসম্যান, তাদের দীর্ঘকালীন সমস্যা চলছে। তার কারণ কি টেকনিক্যাল নাকি প্রয়োগ সংক্রান্ত নাকি মানসিক? এই প্রশ্নের উত্তর এবং সমাধান যদি সেই সাপোর্ট স্টাফদের কাছে না থাকে তাহলে তাদের এত টাকা দিয়ে তাঁদের পোষার অর্থ কি? তারা কি শুধুই বোর্ডের টাকায় বিদেশে ঘুরতে যান?

যদি যান ও, তাতে আমাদের কোন আপত্তি থাকার কথা নয়, যেহেতু বোর্ড স্বশাসিত সংস্থা। কিন্তু বিষয় হলে সেটা খোলাখুলি বলে দিলে মনের মধ্যে এই অযথা প্ৰশ্ন গুলো ঘুরপাক খায় না। যে খেলাটার সঙ্গে কোটি কোটি মানুষের আবেগ জড়িয়ে আছে, যে সাধারণ মানুষ পরোক্ষে বোর্ডের কোষাগার ভরতে সাহায্য করে, তাদের এটুকু অন্তত: জানার অধিকার আছে।

আর এনারা নিজেরাও কম দায়ী নন। হাতের কাছে সুনীল গাভাস্কার, শচীন টেন্ডুলকারের মতো মানুষ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা ওনাদের কাছে যাওয়ার বা পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না। অথচ এই শচীনকেই বা তার সময়ের অন্য খেলোয়াড়দের বহুবার দেখা গেছে নিজের অফ ফর্মে থাকাকালীন আগের প্রজন্মের ক্রিকেটারদের নেট এ ডেকে ভুল শুধরে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে, একটা কঠিন সিরিজের আগে ব্যক্তিগত চেষ্টায় নিজেদের আরও ধারালো করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা। কিন্তু এনাদের ইগো এতটাই বেশি এবং ম্যাচের বাইরে প্র্যাকটিস করার সময় এতটাই কম যে এনারা এসবের ধার ধারেন না।

ফল? অপেক্ষায় থাকা। আরও ব্যাটিং ব্যর্থতার। খুব তাড়াতাড়ি।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...