সাও পাওলোর ঘিঞ্জি গলিতে রুগ্ন এক বালক ছুটছে। পায়ে অগোছালো একটা বল, শরীর ঘামে ভিজে চুপচুপে। পেটে খিদে, তবুও ক্লান্তি নেই এক বিন্দু। লক্ষ্য একটাই, গোল করতে হবে, বল ওই লক্ষ্যভেদ হওয়ার আগ পর্যন্ত নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে, ড্রিবলিং দিয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণকে মিশিয়ে দিতে হবে মাটির সাথে।
ফুটবল মানেই তো জীবন, সেই জীবনে লড়তে হবে নিজের শেষ সামর্থ্য অবধি। ওই লড়াইটা সাও পাওলোর গলিতে, ফ্ল্যামেঙ্গোর মাঠে, ব্রাজিলের ময়দানে শিখে এসেছেন ভিনিসিয়াস। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে আজকাল যা করছেন সেটার শিক্ষা কিংবা দিক্ষা ভিনি পেলে পেয়ে গেছেন সেই শৈশবেই।
সেই ফুটবল জীবনেই এবার নিজের সেরা স্বীকৃতি পেতে পারতেন ভিনি। পারেননি, স্পেনের রদ্রির কাছে হেরে গেছেন শেষ অংকের লড়াইয়ে। তাই বলে কি লড়াই থামবে, অলিগলিতে খাওয়া হোঁচট খেয়েই তো ভিনি হয়ে উঠেছেন আজকের বিশ্বসেরা।
হ্যাঁ, ভিনিই বিশ্বসেরা, সেই স্বীকৃতি ফ্রান্স ফুটবল দিক কিংবা নাই দিক। তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব তাঁর প্রতিটা গোলে, প্রতিটা অ্যাসিস্টে কিংবা প্রতিটা উদযাপনে। সেখানে মিশে আছে সংগ্রাম, ঘাম আর হাজারো হোঁচট খাওয়ার গল্প।
যেন সাও পাওলোর ঘিঞ্জি গলির নোংরা ডি বক্স ধাঁধিয়ে হাঁকানো এক সাইড ভলি। বলির গতির সামনে দিশেহারা গোলরক্ষক মেনে নিতে বাধ্য হলেন, এই ছেলেটা অন্য রকম। যেমন ছিলেন রোনালদো নাজারিও কিংবা রোনালদিনহো। ফুটবল বিশ্বও বলে দিতে বাধ্য – এই ছেলেটা এখন বিশ্বসেরা, ওকে একটা ব্যালন ডি’অর দিয়ে যাচাই করা যায় না!
বছরখানেক আগেই রিয়াল কোচ কার্লো অ্যানচেলোত্তি বলেছিলেন, দ্রুতই ভিনিসিয়াস জুনিয়রের হাতে উঠবে ব্যালন ডি’অরের ট্রফি। ইতালিয়ান এই গ্রেট কোচকে নিয়ে সেদিন ট্রল করার লোকের অভাব ছিল না। কোচের সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি করে ভিনিসিয়াস সেই পথেই ছুটছিলেন দ্রুত। পারেননি একটা জায়গাতেই, ক্লাব ফুটবলে তাঁর যে অবারিত সাফল্য তার ছিটেফোঁটাও ছিল না জাতীয় দলে।
গেল মৌসুমে ভিনিসিয়াস ব্রাজিল ও রিয়ালের হয়ে সব মিলিয়ে ৪৯টি ম্যাচ খেলে ২৬টি গোল করেছেন, সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন ১১টি। পরিসংখ্যান বলে, প্রতি ১৪৬ মিনিটে গোল করেছেন ভিনি। ড্রিবল করেছেন ৪১.৬ শতাংশ। জিতেছেন তিনটি শিরোপা — উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ, লা লিগা ও স্প্যানিশ সুপার কাপ। এই ভিনিকে অগ্রাহ্য করে গেছে ফ্রান্স ফুটবল, কারণ জাতীয় দলের হয়ে ছিল না কোনো সাফল্য।
প্যারিসের থিয়েটার দো শাতলেতে ভিনিসিয়াস ছিলেন না। ছিলেন না রিয়াল মাদ্রিদের কেউ। টুইটারে ভিনি জানিয়েছেন, ১০ গুণ প্রতাপে তিনি ফিরবেন। হ্যাঁ, ভিনিকে ফিরতে হবেই।
পূর্বসূরি রোনালদো নাজারিও, রিভালদো, রোনালদিনহো কিংবা কাকাদের চূড়ায় নিজেকে নিয়ে যেতে পারতেন এই ব্রাজিলিয়ান। পারেননি। ১৭ বছর বাদে কোনো ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারের হাতে উঠতে পারত ব্যালন ডি’ অরের খেতাব। ওঠেনি। ব্রাজিলের নয়, যা অর্জন সব ভিনির ও রিয়ালের হয়েই। রিয়ালের হয়ে তো জিতছেনই, চাইলে এবার ব্রাজিলের হয়ে জেতার চ্যালেঞ্জটাও নিয়ে দেখতে পারেন ভিনি।
বিশ্বকাপ ব্রাজিল জিততে পারছে না ২২ বছর হয়ে গেছে। দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ। নিশ্চয়ই ভিনিসিয়াস কোনো ঋণ রেখে রাতে ঘুমাতে চাইবেন না। ব্যালন ডি’অরের চেয়ে বিশ্বকাপ ট্রফির উজ্জ্বলতা যে অনেক বেশি সেটা একজন ব্রাজিলিয়ানের চেয়ে ভাল কেই বা জানে!