একটি অ্যাসিস্ট ও স্বপ্নের দরজায় ইতিহাসের ধাক্কা

এত এত বিশ্লেষণের ভিড় ঠেলে কচ্চিৎ-কদাচিৎ এমন কয়েকটা মূহূর্ত চলে আসে, যাকে নিয়ে আর লেখা যায় না। কলম আপনিই থেমে যায় পর্বতের কাছে। কথা বন্ধ হয়ে যায়। এই টেরিফিক ব্রিলিয়ান্সিটা যার রয়েছে, এই যে সমস্ত অ্যানালিস্ট, ডেটা কালেক্টর, গ্রাফ ডিজাইনার, হ্যান-ত্যান... এসবকে একধারসে চুপ করিয়ে দেওয়ার অতিমানবীয় ক্ষমতা যার আছে, তাকে তো পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফুটবলার বললে বিশেষ অত্যুক্তি হয় না।

এত এত বিশ্লেষণের ভিড় ঠেলে কচ্চিৎ-কদাচিৎ এমন কয়েকটা মূহূর্ত চলে আসে, যাকে নিয়ে আর লেখা যায় না। কলম আপনিই থেমে যায় পর্বতের কাছে। কথা বন্ধ হয়ে যায়। এই টেরিফিক ব্রিলিয়ান্সিটা যার রয়েছে, এই যে সমস্ত অ্যানালিস্ট, ডেটা কালেক্টর, গ্রাফ ডিজাইনার, হ্যান-ত্যান… এসবকে একধারসে চুপ করিয়ে দেওয়ার অতিমানবীয় ক্ষমতা যার আছে, তাকে তো পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফুটবলার বললে বিশেষ অত্যুক্তি হয় না।

কথা হচ্ছে, ক্লাব ফুটবলের পিকে থাকার সময় মেসি এ ধরণের অ্যাসিস্ট তো দূর কি বাত, গোল প্রচুর করেছে। গেটাফে দিয়ে শুরু, তারপর চেলসি, রোমা, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড হয়ে অ্যাথলেটিক বিলবাও। কিছুই বাদ রাখেনি। ফলস নাইনে সামনে এটো আর নিচে জাভি-ইনিয়েস্তাকে সঙ্গে নিয়ে সেই হেক্সা জেতার বিরল রেকর্ডটাও সেই সময়ের বার্সেলোনার দখলে।

তো ঐ অ্যাসিস্টটা নিয়ে কথা বলারই জায়গা নেই কারণ ওসব আকছার হয়েছে। লিওনার্দোকে যদি বলা হয়, আপনি পারবেন সেকেন্ড মোনালিসা আঁকতে? অক্লেশে কাটকাট করে বলেও দেবে বোধহয়, হ্যাঁ হ্যাঁ পারব। ১০ বারে ১০ বারই পারব। আসলে একসময় এসে এগুলো প্রকৃত শিল্পীর কাছে স্রেফ বাঁ হাতের কাজ হয়ে যায়।

আর ধন্যবাদ দিতে হয় লিওনেল স্কালোনিকে। যেভাবে ম্যাচ বাই ম্যাচ অপোনেন্ট মেপে মেপে স্ট্র্যাটেজি ঠিক করছে, দেখে ঈর্ষা করা উচিত। নেদারল্যান্ডস ম্যাচে তিন ব্যাক রেখে আপে ঠেলে দিয়েছিল দুটো উইংব্যাককে। ফলে ডিপে আর গ্যাকপো জায়গা পায়। আজ মাঝে নামিয়ে দিল চারটে মিডকে। লম্বা করিডর তৈরি করে অপেক্ষা করল অপোনেন্টে মিডল থার্ডকে ভেতরে টানার।

আর যেই ব্রজোভিচ অন দ্য বল করিডরে ঢুকতে চাইছে তখন নিজেকে আবিষ্কার করছে ১×২ তে। এবং সেটা প্রায় প্রত্যেকেই। মদ্রিচ এক্সপিরিয়েন্সের জোরে দুটো প্লেয়ারের মাঝখান থেকে বহু সময় বল বার করেছে। মিড করিডর পেরিয়ে ডিপ ডিফেন্সে প্রায় থ্রেটই তৈরি করতে পারেনি ক্রোটরা। অথচ শুরুটা কিন্তু ইমপ্রেসিভ করেছিল। বল পজিশন রেখে মাঝের দখল নেওয়ার একটা স্বভাবসুলভ পরিস্থিতি তৈরি করতে চেয়েছিল। কিন্তু বিতর্কিত পেনাল্টি, ম্যাক অলিস্টার, পারাদেস, দে পল আর এঞ্জোর ব্যাক করিডর সব জল ঢেলে দিল।

এরপর আর কিছু উপায় ছিল না ব্রজোভিচকে তুলে পেটকোভিচকে নামানো ছাড়া। প্রথমত ২০১৮-র ক্রোয়েশিয়ায় এই পরিস্থিতিতে একটা ম্যানজুকিচ আর তুখোড় ফর্মের পেরিসিচ ছিল। নিচ থেকে লম্বা থ্রু বাড়ানো রাকিটিচ ছিল। রাকিটিচের থেকেও এফেক্টিভ হতো ম্যানজুকিচের মতো কাউকে পেলে কারণ এ টিমের ডিফেন্স আর মিড ভাল হলেও ক্লিনিক্যাল নয়। ডিপ থ্রেট দেওয়ার ক্ষমতা ক্র্যামারিচের নেই।

ইভেন সারা ম্যাচে বহুবার ট্র্যাকব্যাক করতে হল প্যালাসিচকে। যে কারণে আপফ্রন্টের শেপটাই বদলে গেল ক্রোটদের। আর মিড করিডর যেহেতু বন্ধ, সোসা আর জুরানভিচের ওভারল্যাপিং বন্ধ হল। প্রায় প্রতি ম্যাচে অবিশ্বাস্য দৌড় বজায় রাখা জুরানভিচ সারা ম্যাচে বারকয়েক ওপরে ওঠার কিঞ্চিৎ চান্স পেল। তার সঙ্গে যুক্ত হল লভরেনের মিসপাস, খেলা এক সাইড থেকে অন্য সাইডে সুইচ করতে গিয়ে বিরাট বিরাট ভুল করে বসল অর্থাৎ অর্গানাইজেশনে চরম ভুলগুলো ঢুকে পড়তে থাকল। ম্যাচ ওখানেই শেষ ক্রোয়েশিয়ার। আর ঐ সুযোগগুলোকে মুড়ি-মুড়কির মতো ব্যবহার করে গেল আর্জেন্টিনা।

প্রথম পেনাল্টির (?) সময় ফলস নাইন আলভারেজ ভেতরে ছুটে এল সেকেন্ড বলের জন্য। সেকেন্ড গোলটা ব্যর্থ প্রেস মদ্রিচ আর ব্রজোভিচের। এবং দুটো সেন্টার ব্যাকের একজনেরও ক্লিয়ারেন্স না করতে পারার কারণ। মিডল থার্ড আটকে যেতে ম্যাচ থেকে তখনই হারিয়েছিল ক্রোয়েশিয়া। ডালিচের হাতে যা যা অপশন ছিল সব ব্যবহার করার পরেও, ঐ টু ইস্টু ওয়ান কম্বিনেশন ভাঙতেই পারেনি। যেটার সদ্ব্যবহার করেছিল ব্রাজিল ম্যাচে, সেটাই বুমেরাং হল আর্জেন্টিনা ম্যাচে।

স্কালোনির এই আর্জেন্টিনা পাগলের মতো প্রেস করে। বল বাই বল থ্রেটের পর থ্রেট তোলে। চার মিড যে খেলছে, সেটাও একটা ধাঁচে নয়। অন পেপার ৪-৪-২ তে শুরু করে ৪-২-৩-১ এ চলে গিয়ে মেসি হয়ে যাচ্ছে সেকেন্ড স্ট্রাইকার, কখনও ৮ নম্বরে নেমে এসে হোল্ডার, বিল্ড আপে সাহায্য করা, আবার পিভট চলাকালীন আলভারেজ নামলে ওপরে একা থেকে যাওয়া। অর্থাৎ গোটা টিমে একমাত্র মেসির ফ্রি রোল। আর সেটা লুটে নিচ্ছে ৩৫-এর বুড়ো জিনিয়াস। যার সুবাদে অলরেডি এই কাপে ৫টা গোল, তিনটে অ্যাসিস্ট। আর সেই তিনটে অ্যাসিস্টের একটা ঐশ্বরিকও বটে!

আর কী বলব! মেসির শেষ কাপ, যেখানে রোনালদো নেই, নেইমার নেই, মুলার নেই, হ্যাজার্ড নেই। কাল মদ্রিচও বিদায় নিল। এই তারা খসে যাওয়ার লড়াইয়ের মাঝে অন্ধকার রাতের হ্যালোজেন হয়ে জ্বলছেন মেসি। এই মেসি সেকেন্ড স্ট্রাইকার হিসেবে নকুড়ের জলভরার মতো অ্যাসিস্ট করেন। লম্বা চুলের মেসি আর এই মেসির এইটাই বেসিক পার্থক্য। বয়স বেড়েছে, সেই গতি আর নেই কিন্তু তা’বলে বাঁ পা তো আর নিজের ব্রিলিয়ান্সি ভুলতে পারে না।

দুই লিওনেলের কাঁধে বহুকাল একটুর জন্য খালি হাতে ফিরে, কিছু না পেয়ে ‘আবার আসিব ফিরে’ বলতে থাকা নীল-সাদারা রোববারের স্বপ্নে বিভোর, এর চেয়ে বড় পুরস্কার নিজের তুলনাহীন কেরিয়ারে আর কখনও পাননি মেসি। এই শেষবার, আর তো একটাই মাত্র ম্যাচ রইল, যেখানে ইতিহাস এসে সজোরে ধাক্কা দিচ্ছে স্বপ্নের দরজায়!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...