অশ্বডিম্বের শেষ কোথায়!

এ কথা ঠিক যে, নিউজিল্যান্ডের আবহাওয়া উপমহাদেশের যেকোনো দলের জন্যই বেশ চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু এই দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের অতি বাজে পারফরম্যান্সকে বৈধতা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ কন্ডিশন যতই কঠিন হোক না কেন, আপনি আপনার সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে লড়াই করবেন, প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা চালাবেন।

শেষ হলো বাংলাদেশের বিভীষিকাময় নিউজিল্যান্ড সফর।

বরাবরের মতো এবারও প্রাপ্তির খাতায় মিলল অশ্বডিম্ব। মাঠের খেলায় পুরো সিরিজজুড়ে প্রবলভাবে সমালোচিত বাংলাদেশ দল যার পেছনে স্বাভাবিকভাবে দায়ী ক্রিকেটাররা নিজেরাই।

এ কথা ঠিক যে, নিউজিল্যান্ডের আবহাওয়া উপমহাদেশের যেকোনো দলের জন্যই বেশ চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু এই দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের অতি বাজে পারফরম্যান্সকে বৈধতা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ কন্ডিশন যতই কঠিন হোক না কেন, আপনি আপনার সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে লড়াই করবেন, প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা চালাবেন। ফলাফল পেলেন কী পেলেন না সেটা পরের বিষয়। ঠিক এখানেই পুরোপুরি ব্যর্থ বাংলাদেশ দল। দ্বিতীয় ওয়ানডেটা বাদ দিলে পুরো সফরে ন্যূনতম প্রতিরোধ গড়া তো দূরের কথা, ব্ল্যাকক্যাপদের সামনে ঠিকমতো দাঁড়াতেই পারেনি বাংলাদেশ।

নিউজিল্যান্ডের সাথে আমাদের শক্তির ও দক্ষতার যথেষ্ট তফাৎ রয়েছে। তাই বলে পুরো সফরে মাঠের খেলায় তিন বিভাগের ব্যর্থতায় যেভাবে গো হারা হারতে হয়েছে বাংলাদেশকে সেরকমটাও হবার কথা নয়। শক্তির পার্থক্য কম-বেশি হতেই পারে। দক্ষতার সীমাবদ্ধতা থাকাটাও খুব স্বাভাবিক। কিন্তু ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি উভয় সিরিজে বাংলাদেশ দল যে খাপছাড়া একটা ভাব নিয়ে মাঠে খেলেছে সেটাই এখন সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হবার বিষয়।

পুরো দলটার মধ্যেই যেন ইতিবাচক অভিপ্রায়ের প্রচণ্ড অভাব। চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা নিয়ে নাঠে নামা, একটা জয় পাওয়ার তীব্র ক্ষুধা কিংবা ম্যাচের শেষ অবধি লড়াই করার মানসিকতার ছাপ বিন্দুমাত্র পাওয়া যায়নি তাঁদের মাঝে। প্রতিটা ম্যাচে ক্রিকেটারদের শরীরী ভাষা ছিল ভয়ানক। গ্রাউন্ড ফিল্ডিংয়ে একের পর এক লোপ্পা ক্যাচ তালু ফসকানোর ব্যাপারটাই পুরো দলের ছন্নছাড়া অবস্থার অকাট্য দলিল হয়ে রয়েছে।

নিউজিল্যান্ড সফরে চরম ব্যর্থতার প্রাথমিক দায়টা ক্রিকেটারদের। কিন্তু ক্রিকেট তো দলীয় খেলা। সেটা কেবল ১১ জনের একটি দলের খেলা না। এই দলের অন্তর্গত কোচিং স্টাফরাও। ক্রিকেটারদের পাশাপাশি তাঁরাও এরকম ব্যর্থতার দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।

তাই খেলোয়াড়দের মতো কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে কোচিং স্টাফদেরও। প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গোকে নিতে হবে দায়। শঙ্কার ব্যাপার হলো তিনি যোগ দেবার পর এখন পর্যন্ত দৃশ্যত কোনো উন্নতিই চোখে পড়েনি বাংলাদেশের। বরঞ্চ তাঁর সময়ে পূর্বের চেয়েও বাজে বাজে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে দলকে। পরিসংখ্যান ঘাটলেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়।

আর এই কোচের পরিকল্পনায়ও রয়েছে যথেষ্ট গলদ। তিনি কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনায় বেশিক্ষণ থাকতে পারেন না। একটা উদাহরণ তো চোখের সামনেই বিদ্যমান। ২০২৩ বিশ্বকাপকে লক্ষ্য রেখে একজন ফিনিশারের অভাব ঘোচাতে গেল হোম সিরিজে ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে সৌম্য সরকারকে আশ্চর্যজনকভাবে সাত নম্বরে খেলান ডমিঙ্গো। সেখানে মাত্র এক ম্যাচে ব্যাটিং করা সেই সৌম্যকে পরের সিরিজেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিন নম্বরে তুলে আনেন তিনি। মানে তাঁর পরিকল্পনা টিকেছিল কেবল এক সিরিজের জন্য।

এর আগে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে মোস্তাফিজুর রহমানকে এই সংস্করণের জন্য অকার্যকর ঘোষণা দিয়ে পরের সিরিজেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট দলে ফেরান প্রধান কোচ। আবার ওই পাকিস্তান সফরের টেস্ট দলে অভিজ্ঞতার জন্য রুবেল হোসেনকে অপ্রত্যাশিতভাবে দলে নিয়ে পরের সিরিজে তাঁকে কেবল সাদা বলের ক্রিকেটের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানান তিনি।

এ তো গেল প্রধান কোচের কথা। বর্তমান পরিস্থিতিতে ফিল্ডিং কোচ রায়ান কুকের  প্রসঙ্গটাও যেন না তুললেই নয়। নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশ দল বাজে ফিল্ডিংয়ের যে চূড়ান্ত নিদর্শন এবার দেখিয়েছে তাতে স্বাভাবিকভাবেই দলে তাঁর অবদান নিয়ে প্রশ্ন ওঠছে। এটা কেবল একটা সিরিজে হলে তেমন উচ্চবাচ্য হতো না৷ কিন্তু বিগত দিনগুলো থেকেই সিরিজের পর সিরিজে অব্যাহত রয়েছে ফিল্ডারদের ক্যাচ তালু ফসকানোর মহড়া। ফিল্ডিং কোচ হিসেবে তাই এ দায়টা তাঁকে নিতে হবে।

এখন প্রশ্ন রাখতেই পারেন, একেবারে সাধারণ ক্যাচগুলোও যে আমাদের ফিল্ডাররা মিস করেছেন তাতে কোচের দায় কতটুকু? কোচ তো সব গিলিয়ে দেবেন না তাঁদের। এই প্রশ্নের জবাব অতি সরল। কাড়ি কাড়ি অর্থ ব্যয় করে বিদেশি কোচ রাখার পরেও যদি ধারাবাহিকভাবে সহজ ক্যাচ তালু ফসকাতেই থাকেন ফিল্ডাররা তবে তাঁর পেছনে এত অর্থ ব্যয় করারও কোনো মানে নেই। লেট হিম জাস্ট গো!

এবার আসি তথাকথিত কয়েকজন তরুণ ক্রিকেটারের প্রসঙ্গে। পৃথিবীতে বাংলাদেশ বোধ হয় একমাত্র ক্রিকেট দল যেখানে পাঁচ-ছয় বছর ধরে খেলা ক্রিকেটাররাও তরুণ বলে বিবেচিত হন। সেই ‘তরুণ’দের মধ্যে সৌম্য, লিটন, তাসকিন ও মোস্তাফিজ অন্যতম।

ব্যক্তিগতভাবে আমি এখনও বিশ্বাস করি তাঁরা প্রত্যেকেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ। তাঁদের প্রতিভা ও সামর্থ্য নিয়ে আমার মনে কোনোরকম সন্দেহ নেই। ব্যর্থতার মিছিলে টানা যোগ দেবার পরেও আমি দ্ব্যর্থহীনভাবেই এ কথাগুলো বলছি। আর তাঁদের সামর্থ্য নিয়ে সন্দেহ করি-ইবা কী করে!

এই সৌম্যই যে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ১২৭ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে ওয়ানডেতে পাকিস্তানকে প্রথমবারের মতো ধবলধোলাই করতে দলকে সাহায্য করেছেন, ভারতের বিপক্ষে বাহারি শটের পসরা সাজিয়ে বোলারদের চোখ রাঙিয়েছেন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডেতে অপরাজিত ৮৮ ও ৯০ রানের টানা দুটি ইনিংস খেলে দলকে সিরিজ জিতিয়ে সিরিজসেরা নির্বাচিত হয়েছেন।

এদিকে এই লিটনই এশিয়া কাপের ফাইনালে চাপের মুখে ভারতের বিপক্ষে ১২১ রানের ঝকঝকে ইনিংস খেলেছেন, উইন্ডিজের বিপক্ষে নিজের প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচে হার না মানা ৯৪ রানের ইনিংস খেলে দলের জয়ে অবদান রেখেছেন এবং ওয়ানডেতে বাংলাদেশের পক্ষে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ১৭৬ রান করার রেকর্ড গড়েছেন। অন্যদিকে তাসকিন ও মোস্তাফিজ ওয়ানডে অভিষেকেই ভারতের বিপক্ষে ৫ উইকেট তুলে নিয়েছেন। জাতীয় দলে দুর্দান্ত বোলিং করে মোস্তাফিজ আইপিএল ও কাউন্টি ক্রিকেটে মাঠ মাতিয়েছেন।

এগুলোই প্রমাণ করে তাঁদের প্রত্যেকের ভালো খেলার সামর্থ্য রয়েছে। কিন্তু অভাব রয়েছে ধারাবাহিকতা এবং ইতিবাচক মানসিকতার। সদ্য সমাপ্ত নিউজিল্যান্ড সিরিজে এই চারজনের পারফরম্যান্স ছিল যাচ্ছেতাই। তবে একের পর এক ব্যর্থতায়ও তাঁদের মধ্যে কোনো হেলদোল দেখা যায়নি। ব্যর্থতায় মুষড়ে না পড়ে বরং নিজেদের পুরোটা নিংড়ে দেওয়ার প্রচেষ্টাও দৃশ্যমান হয়নি তাঁদের খেলায়।

ক্রিকেট যে একটি মনস্তাত্ত্বিক খেলা সেটা কারো অজানা নয়। এই মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়েও পিছিয়ে আমাদের সামর্থ্যবান ভবিষ্যৎ কাণ্ডারিরা। তাঁদের অধিকাংশের মাঝেই অল্পতে তুষ্ট হবার প্রবণতা রয়েছে। রয়েছে আত্মবিশ্বাসের অভাব। তাঁরা বারবার ভুল করেন এবং সে ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলেন। তবে সেটা ওই বলা পর্যন্তই। যে কারণে একই ভুল দিনের পর দিন, ম্যাচের পর ম্যাচে করতে দেখা যায় তাঁদের।

অনেক সময় তো হলো। এবার অন্তত পারফরম্যান্সে পরিণত হওয়া উচিত তাঁদের। এই সৌম্য, লিটন, তাসকিন, মোস্তাফিজের মতো প্রতিভা নিয়ে বাংলাদেশে খুব কম ক্রিকেটারই এসেছেন। তাঁদেরকে সে প্রতিভার মূল্য উপলব্ধি করতে হবে৷ কারণ মাঠে প্রয়োগ করতে না পারলে সে প্রতিভার যে কোনোই মূল্য নেই!

তাছাড়া দিনকে দিন পারফর্ম না করেও তাঁদের নিশ্চিন্ত থাকার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের দুর্বল পাইপলাইন। কারণ যোগ্য বিকল্পের অভাবে টানা ব্যর্থতার পরেও ঘুরেফিরে তাঁরাই দলে টিকে যান। সেক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ব্যর্থ হবার পরেও দলে নিজেদের জায়গা নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয় না তাঁদের।

পাইপলাইনের কথা বলায় ক্রিকেট বোর্ড সম্পর্কেও দুই-চার কথা বলতে হয়। বেশিরভাগ সময়ই পাইপলাইনে যথেষ্ট খেলোয়াড় আছে বলে গলাবাজি করে যান আমাদের বোর্ডকর্তারা। অথচ চোটাক্রান্ত রিয়াদের বিকল্প খুঁজে পান না তাঁরা। লিটন-সৌম্য-মিঠুনের বিকল্প খুঁজে পেতে রীতিমতো হিমশিম খান। সাকিবের বিকল্পের কথাটা আর না-ই তুললাম।

বাংলাদেশের কোনো ‘এ’ দল নেই। অন্ধের যষ্টি হিসেবে আছে ইমার্জিং দল। ওই দলও পর্যাপ্ত পরিমাণ ম্যাচ খেলার সুযোগ পায় না। শক্তিশালী দলগুলোর বিপক্ষে খেলা তো দূরতম কল্পনা! নামকাওয়াস্তে আয়ারল্যান্ড উলভসের মতো খর্বশক্তির দলের বিপক্ষে সিরিজ খেলিয়েই দায় সারে বোর্ড। যে কারণে নাজমুল হোসেন শান্তর মতো প্রতিভাধর ক্রিকেটার বয়সভিত্তিক দলের সবগুলো সিড়ি মাড়িয়ে, ইমার্জিং দলকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেও জাতীয় দলে রান পেতে রীতিমতো সংগ্রাম করেন।

সবশেষে বলতে হয়, এই নিউজিল্যান্ড সফরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কঙ্কালসার দেহটাই দৃশ্যমান হয়েছে। তবে এখনই যে সব শেষ হয়ে গেছে এমনটিও নয়। বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট একটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি এর আগেও বাংলাদেশকে হতে হয়েছে এবং সফলভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর উদাহরণও রয়েছে তাঁদের।

বর্তমানের এ বাজে সময়টা থেকে দ্রুত বের হতে চাইলে সবাইকে একযোগে কাজ করার বিকল্প নেই। ক্রিকেটার ও বোর্ডকর্তাদের একে অপরকে দোষারোপ না করে বরং একসাথে বসে আলোচনার সাপেক্ষে উত্তরণের পথ বাতলানোর চেষ্টা করা দরকার। কেননা ক্রিকেট একটা দলীয় খেলা। এই খেলায় ক্রিকেটাররা একটা দলের জন্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ, কোচিং স্টাফ ও বোর্ডকর্তারা তার চেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...