কোহলি যদি নো-বলের আবেদনই না করতেন…

পুরোটা সময় পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচের শেষ বলে এসে পাকিস্তানকে চার উইকেটে পরাজিত করে ভারত। তবে, বৃষ্টির শঙ্কা কিংবা ম্যাচের অন্তিম মুহূর্তের লড়াই - সব ছাপিয়ে ম্যাচের নায়ক কিংবা খল-নায়ক বনে গিয়েছে ওই একটা নো বল।

ভারত পাকিস্তান মহা কাব্যিক ম্যাচ, তবে বৃষ্টি প্রস্তুত ছিল এই ম্যাচ ঘিরে কোটি মানুষের উন্মাদনাকে ভাসিয়ে দিতে। তবে ক্রিকেট ভক্তদের প্রার্থনা শুনলেন সৃষ্টিকর্তা, বৃষ্টির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মেলবোর্নে শুরু হলো ম্যাচ। ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা এই লড়াইয়ে মাঠে থেকে দেখতে উপস্থিত ছিলেন ৯০ হাজার ২৯৩ জন দর্শক। পুরোটা সময় পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচের শেষ বলে এসে পাকিস্তানকে চার উইকেটে পরাজিত করে ভারত। তবে, বৃষ্টির শঙ্কা কিংবা ম্যাচের অন্তিম মুহূর্তের লড়াই – সব ছাপিয়ে ম্যাচের নায়ক কিংবা খল-নায়ক বনে গিয়েছে ওই একটা নো বল।

মেলবোর্নের আকাশের অবস্থার কথা মাথায় রেখে টস জিতে বোলিং করার সিদ্ধান্ত নেন ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত শর্মা। মেঘাচ্ছন্ন আকাশের সাথে উইকেটের আর্দ্রতাকে কাজে লাগিয়ে ভারতীয় দুই পেসার আর্শদ্বীপ সিং ও ভুবনেশ্বর কুমার সুইং বোলিংয়ে নাভিশ্বাস তোলেন পাকিস্তানের দুই ওপেনার বাবর আজম ও মোহাম্মদ রিজওয়ানের। নিজের মুখোমুখি প্রথম বলেই এলবিডব্লিউর শিকার হন পাকিস্তানের অধিনায়ক। আর্শদ্বীপ সিংয়ের করা দ্বিতীয় ওভারে তুলে নেন পাকিস্তানের আরেক ওপেনার মোহাম্মদ রিজওয়ানকে।

১২ বলে মাত্র ৪ রান করে থার্ড ম্যান অঞ্চলে ভুবনেশ্বর কুমারের ক্যাচ হয়ে সাজঘরে ফেরেন এই উইকেট কিপার ব্যাটার। চার ওভার যেতে না যেতেই ১৫ রানে দুই উইকেট হারিয়ে কাঁপছে পাকিস্তান। এমন সময় ত্রাণকর্তার ভূমিকায় হাজির দুই মিডল অর্ডার ব্যাটার শান মাসুদ ও ইফতেখার আহমেদ। যাদের বাজে পারফরম্যান্সের কারণে দলে থাকায় শঙ্কা ছিল তারাই জ্বলে উঠলেন ব্যাট হাতে। ৯ ওভারে ৫০ রান থেকে ১২ ওভারে ৯১ রান, মাঝখানের তিন ওভারে ৪১ রান নিয়ে পাকিস্তানকে লড়াইয়ে ফেরায় ইফতেখার আহমেদ ও শান মাসুদ।

এই দুজনের ৫০ বলে ৭৬ রানের জুটি ম্যাচে ফেরালো পাকিস্তানকে। ৩৪ বলে ৫১ করার পর পরই মোহাম্মদ শামির বলে এলবিডব্লিউর ফাঁদে পড়েন ইফতেখার আহমেদ। এর পরের ২৬ বলে পাকিস্তান ব্যাটিং লাইনআপের উপর দিয়ে রীতিমতো ঝড় বয়ে গেল। ১২.২ ওভার থেকে ১৬.৪ ওভার পর্যন্ত ২৯ রানের বিনিময়ে  পাঁচ উইকেট হারিয়ে আবারও খাঁদের কিনারায় পাকিস্তান। তবে এক প্রান্তে শান মাসুদ ছিলেন অবিচল। এরপর শান মাসুদের সাথে শাহীন শাহ আফ্রিদির ১৬ বলে ৩১ রানের জুটিতে ১৫০ পার করে পাকিস্তান।

শুরুর ধাক্কার পর তৃতীয় উইকেটে দারুন পার্টনারশিপে ১৭০ পার করার স্বপ্ন দেখা পাকিস্তানের ইনিংস থামে ২০ ওভারে ৮ উইকেটে ১৫৯ রানে। শাহীন শান আফ্রিদি ৮ বলে ১৬ ও শান মাসুদ অপরাজিত ৪২ বলে ৫২ রান করেন। ভারতের হার্দিক পান্ডিয়া ও আর্শদ্বীপ সিং তিনটি করে উইকেট নেন। 

১৬০ রানের চ্যালেঞ্জিং টার্গেটে ব্যাট করতে মাঠে নেমে ভারত ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে। দলীয় ৬.১ ওভারের মধ্যেই ৩১ রান তুলতে ওপেনার লোকেশ রাহুল, অধিনায়ক রোহিত শর্মা, সূর্য কুমার যাদব ও অক্ষর প্যাটেল আউট হয়ে যান। উইকেট আর কন্ডিশনকে কাজে লাগিয়ে ভারতীয় ব্যাটারদের রীতিমতো নাস্তানাবুদ করতে থাকে পাকিস্তানি বোলাররা। পাকিস্তানি পেসার হারিস রউফ বিগ ব্যাশে মেলবোর্ন স্টারসের হয়ে খেলার সুবাদে মেলবোর্ন স্টেডিয়াম যার অনেকটা ঘরের মাঠের মতোই, তিনি বোলিংয়ে এসেই  চতুর্থ ও ষষ্ঠ ওভারে ফেরান অধিনায়ক রোহিত শর্মা ও আইসিসি রাঙ্কিংয়ের দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান সুরিয়াকুমার যাদবকে।

এর আগে ও পরে নাসিম শাহের বলে প্লেইড অন হয়ে লোকেশ রাহুল আর অক্ষর প্যাটেল কাঁটা পড়েন রান আউটে।  তবে উইকেট ঝড়ের মাঝেই টিকেছিলেন বড় ম্যাচের খেলোয়াড় বিরাট কোহলি। পঞ্চম উইকেটে মাঠে নামা হার্দিক পান্ডিয়াকে সাথে নিয়ে ইনিংস মেরামতে মনোযোগ দেন এই ব্যাটিং গ্রেট। ধীরে সুস্থে উইকেট না দেওয়ার ভাবনায় খেলতে  থাকেন দুই ব্যাটার। ১০ ওভার শেষে ভারতের রান দাঁড়ায় চার উইকেট হারিয়ে মাত্র ৪৫ রান।

শেষ ১০ ওভারে জয়ের জন্য ভারতের দরকার ছিল ১১৫ রান , পাকিস্তানের প্রয়োজন ৬ উইকেট। এমন অবস্থায় বিরাট কোহলি আর হার্দিক পান্ডিয়ার প্রতি আক্রমনে মোহাম্মদ নাওয়াজের এক ওভারে ২০ রান সহ পরের পাঁচ ওভারে কোনো উইকেট না হারিয়ে তোলেন ৫৫ রান। ১৫ ওভার শেষে কাটায় কাটায় শতরান শেষ পাঁচ ওভারে ৬০ রানের লক্ষ্য দাঁড়ায় ভারতের জন্য।১৬ ও ১৭ এই দুই ওভারে মাত্র ১২ রান দিয়ে পাকিস্তানের দিকে ম্যাচ টেনে আনেন দুই পেসার হারিস রউফ ও নাসিম শাহ।

তবে শাহীন শাহ আফ্রিদির করা  ১৮তম ওভারে ১৭ রান তুলে ম্যাচ আবারও জমিয়ে দেন বিরাট কোহলি। ইনিংসের ১৮ তম ওভারে শাহীন শাহ আফ্রিদিকে চার মেরে নিজের অর্ধশতক পূর্ন করে পাকিস্তান। এরপর হারিস রউফের করা ১৯তম ওভারে দুই ছয়ে ১৫  রান নিলে শেষ ওভারে জয়ের জন্য ১৬ রানের দরকার হয় ভারতের। পাকিস্তানের পেসারদের বোলিং কোটা শেষ হয়ে যাওয়ায় বাবর আজম বোলিংয়ে আনেন স্পিনার মোহাম্মদ নাওয়াজকে। মোহাম্মদ নাওয়াজের করা শেষ ওভারের প্রথম বলে ফিরে যান হার্দিক পান্ডিয়া।

এরপর এক রান নিয়ে দীনেশ কার্তিক বিরাট কোহলিকে স্ট্রাইক দিলে এক ছয় হাঁকিয়ে দলকে। আর এখানেই ঘটে আসল ঘটনা।  

তিন বলে যখন ভারতের ১৩ রান দরকার তখন একটা ফুল টসে ছক্কা হাঁকান। অফ স্ট্যাম্পের বাইরে বেশ উঁচু একটা ফুল টস ছিল। ডিপ স্কয়ার লেগ দিয়ে কোহলি বলটা তুলে মেরেই আম্পায়ারের কাছে নো বলের আবেদন করেন। লেগ আম্পায়ারের নো-এর ডাক দেন। তখন পাকিস্তানের অধিনায়ক বাবর আজম-সহ অনেকেই এগিয়ে আসেন। আম্পায়ার রড টাকার আর ম্যারিয়াস ইরাসমাসের সাথে পাকিস্তানের অধিনায়ক ও খেলোয়াড়দের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়।

যদিও, এর ফলাফল শূন্য। কারণ, টেলিভিশন রিপ্লেতে দেখা যায়, বলটা কোহলির কোমরের ওপরে ছিল। ফলে, বলটাকে নো ডাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। ভাগ্যিস, কোহলি উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে আবেদন করেছিলেন, না হলে হয়তো জয় বঞ্চিত হতে হত ভারতকে।

এরপরের ডেলিভারি ওয়াইড। পরের ফ্রি-হিটে বাই থেকে তিন রান।  দুই বলে দুই রান প্রয়োজন এমন মুহূর্তে দীনেশ কার্তিক স্ট্যাম্পড হয়ে আউট হয়ে গেলে শেষ বলে ওয়াইড ও রবিচন্দ্রন অশ্বিনের এক রানে পাকিস্তানকে হারায় ভারত। বিরাট কোহলি দলের হয়ে সর্বোচ্চ ৫৩ বলে ৮২ রান করেন। পাকিস্তানের হয়ে দুইটি উইকেট নেন হারিস রউফ ও মোহাম্মদ নাওয়াজ । ম্যাচ জুড়ে দারুণ ব্যাটিংয়ে ম্যাচ সেরা হন বিরাট কোহলি।

পাকিস্তানের শুরুতেই উইকেট হারানো আবার অফফর্ম দুই ব্যাটার শান মাসুদ-ইফতেখার আহমেদের জুটিতে ম্যাচে ফিরে ,হার্দিক পান্ডিয়ার ঝড়ে ম্যাচে পিছিয়ে পড়া শেষ দিকে শাহীন শাহ আফ্রিদির ব্যাটে চ্যালেঞ্জিং স্কোর দাড় করানো। জবাব দিতে নেমে ভারতেরও শুরুতে বিপর্যয় এরপর বিরাট কোহলি-হার্দিক পান্ডিয়ার ব্যাটে ঘুরে দাঁড়ানো। কি ছিলো না এই ম্যাচে। উইকেট,চার-ছয়, দারুন সব স্পেলের এই ম্যাচে দিন শেষে যদিও জয়ী দলের নাম ভারত তবুও বলতে হবে, এই ম্যাচে জয় হয়েছে ক্রিকেটের, ক্রিকেটপ্রেমী কোটি মানুষের।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...