ব্যাডমিন্টনের ‘ফ্যামিলি ম্যান’

তখনো ভারতের ১৯৮৩ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিততে অনেকটাই দেরী, কলকাতা ময়দানের ‘তারা’দের উজ্জ্বলতায় তখনো ফুটবলই ছিল প্রধান ও প্রথম খেলা।তারপর আস্তে আস্তে আমার আপাত বড় হয়ে যাওয়া, মাঠ ফুরনো আর কোর্ট জুড়নো এবং ১৯৭৮ নাগাদ ব্যাংক চাকরির পেশায় জড়িয়ে পরা।

আমার কৈশোরে শীতের শুরুতে পাড়ার মাঠে ব্যাডমিন্টন খেলার প্রস্তুতি শুরু হত। এমনিতে সারা বছর ফুটবল আর ক্রিকেট খেলার মাঠটাই হয়ে যেত ব্যাডমিন্টন কোর্ট। লাইন কাটা হত, তার উপর চুন পড়ত, দুপাশে স্ট্যান্ড এবং সেই স্ট্যান্ডে নেট টাঙ্গানো হত। শীতের সন্ধেগুলো রমরমিয়ে চলত গা গরম করা ব্যাডমিন্টন, পুরো শীতকাল জুড়ে।

তখনো ভারতের ১৯৮৩ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিততে অনেকটাই দেরী, কলকাতা ময়দানের ‘তারা’দের উজ্জ্বলতায় তখনো ফুটবলই ছিল প্রধান ও প্রথম খেলা।তারপর আস্তে আস্তে আমার আপাত বড় হয়ে যাওয়া, মাঠ ফুরনো আর কোর্ট জুড়নো এবং ১৯৭৮ নাগাদ ব্যাংক চাকরির পেশায় জড়িয়ে পরা।

সেই ব্যাঙ্কে ঢুকেও এবং কলকাতা থেকে অনেকটাই দূরে পোস্টিং পেলেও ‘মাঠ’-এর কৌতূহলটা ছেড়ে গেল না আমাকে।মোহন, ইস্ট, সানি, ভিশি এসব যেন আগের থেকে আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরলাম। এবং জানলাম, আমার ব্যাংকে এক আন্তর্জাতিক মানের ‘শাটলার’ চাকরি করেন। তাঁর নাম প্রকাশ পাড়ুকোন। খুব বেশিদিন অবশ্য ব্যাংকের পেশায় ছিলেন না প্রকাশ পাড়ুকোন।

তার বাবা রমেশ পাড়ুকোন ছিলেন মহীশূর ব্যাডমিন্টন অ্যাসোসিয়েশনের সচিব। বাবার সূত্রেই ব্যাডমিন্টন নামক চুম্বকে আকর্ষিত হয়েছিলেন প্রকাশ। ১৯৬২ সালে, মাত্র সাত বছর বয়সে প্রথম বড় টুর্নামেন্ট (কর্ণাটক স্টেট জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ) খেলেন এবং প্রথম রাউন্ডেই হেরে যান। কিন্তু তা থেকে শিক্ষা নিয়ে দু’বছর পরেই তিনি কর্ণাটক স্টেট জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন হন।

১৯৭১ থেকে আক্রমণাত্মক খেলায় অভ্যস্ত হন এবং ১৯৭২ সালে ১৭ বছর বয়সে হয়েছিলেন ভারতের জাতীয় জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন। এবং সেই বছরেই তিনি ভারতের জাতীয় সিনিয়র চ্যাম্পিয়নও হন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮, টানা সাত বারের জাতীয় সিনিয়র চ্যাম্পিয়ন প্রকাশ তার প্রথম আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক জেতেন ওই ১৯৭৮ সালেই, কানাডার এডমন্টনে কমনওয়েলথ গেমসে সিঙ্গলস চ্যাম্পিয়ন হয়ে। আর ১৯৭৯ সালে প্রকাশ জেতেন লন্ডনের রয়াল অ্যালবার্ট হলে ‘ইভনিং অফ চ্যাম্পিয়নস’ টাইটেল (ইংলিশ মাস্টার্স)।

এরপর আসে তার সোনার বছর ১৯৮০। প্রথমে ডেনমার্ক ওপেন আর তারপরে সুইডেন ওপেন জেতেন তিনি সেই বছর। আর এই দুই জয়ের মাঝে ১৯৮০ সালের ২৩ মার্চ তারিখে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে অল ইংল্যান্ড ব্যাডমিন্টন চ্যামপিয়নশিপ জিতে হইহই ফেলে দিয়েছিলেন ততদিনে বিখ্যাত হয়ে যাওয়া ক্রিকেটার সানি গাভাস্কারের ২৪ বছর অতিক্রান্ত বন্ধু প্রকাশ পাড়ুকোন।

সেটাই ছিল কোন ভারতীয়র প্রথম অল ইংল্যান্ড ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা।পরে ২০০১ সালে পুল্লেলা গোপীচাঁদ দ্বিতীয় ভারতীয় শাটলার হিসেবে অল ইংল্যান্ড ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিলেন।

১৯৮০র অল ইংল্যান্ড ব্যাডমিন্টন চ্যামপিয়নশিপের ফাইনালে ইন্দোনেশিয়ার লিয়েম সুই কিংকে ১৫-৩, ১৫-১০ ফলে উড়িয়ে দেওয়া প্রকাশ পাড়ুকোন সেবার প্রতিযোগীতার ৫ ম্যাচের একটি গেমেও পরাজিত হননি। ফাইনালের আগে রাউন্ড অফ ৩২-এ সুফিয়ান আবু বেকারকে ১৫-৭, ১৫-১২ পয়েন্টে, রাউন্ড অফ ১৬-তে হাদিয়ান্তোকে ১৫-০, ১৫-১০ পয়েন্টে, কোয়ার্টার ফাইনালে প্রিকে ১৫-৪, ১৫-৪ পয়েন্টে আর সেমিফাইনালে ফ্রস্ট হ্যানসেনকে ১৫-৮, ১৫-১০ পয়েন্টে হারিয়ে দিয়েছিলেন প্রকাশ পাড়ুকোন।

যেমনটা হয়, তখন ভারতে একটু হলেও জনপ্রিয়তা বেড়েছিল ব্যাডমিন্টনের, মনে আছে। কিন্তু ব্যাডমিন্টন আজও সেভাবে ভারতের আমজনতার খেলা হতে পারেনি। ২০২২য়ের টমাস কাপ জয় সেটা সম্ভব করবে কিনা, তা কৌতূহলের বিষয়।

এছাড়াও তিনি জিতেছিলেন ১৯৮১ সালের ইন্ডিয়া ওপেন ও ১৯৮২ সালে ডাচ ওপেন। ব্যাডমিন্টন বিশ্বকাপে ১৯৮১ সালের সোনা আর ১৯৮৩র ব্রোঞ্জ, ব্যাডমিন্টন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ১৯৮৩’র ব্রোঞ্জ, বিশ্ব গেমসে ১৯৮১’র ব্রোঞ্জ ও এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ১৯৭৬’র ব্রোঞ্জ। ১৯৭২য়ের অর্জুন পুরস্কার ছাড়াও ১৯৮২-তে প্রকাশ পেয়েছিলেন পদ্মশ্রী পুরস্কার।

১৯৯১ সালে তিনি খেলা থেকে অবসর নেন, তখন তিনি ৩৬। পরে অল্পদিনের জন্য ভারতের ব্যাডমিন্টন অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। ভারতের জাতীয় ব্যাডমিন্টন দলের কোচ ছিলেন ৪ বছর, ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬। ভারতে বিলিয়ার্ড তারকা গীত শেঠীর সঙ্গে প্রকাশ পাড়ুকোন যৌথ উদ্যোগে ভারতের অলিম্পিক ইভেন্টগুলিতে উন্নতির জন্য একটি ফাউন্ডেশন করেছিলেন, যার নাম ছিল ‘অলিম্পিক গোল্ড কোয়েস্ট’।

তাঁর স্ত্রী উজ্জ্বলা পাড়ুকোন একজন সাবেক ট্র্যাভেল ম্যানেজার। তাঁদের দুই মেয়ে দীপিকা পাড়ুকোন ও অনীশা পাড়ুকোন। ছোটবেলায় তারাও খেলার মধ্যেই ছিলেন। দীপিকা ছিলেন ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় আর অনীশা ছিলেন গলফ খেলোয়াড়। এখন পেশায় দীপিকা অভিনেত্রী আর অনীশা গলফ খেলোয়াড়। শ্রীদেবীর সঙ্গেও নেটে ছবি পেয়েছি প্রকাশের, দীপিকার অভিনেত্রী হবার বীজমন্ত্র হয়ত সেখানেই ছিল।

ভারতের আমজনতাকে অবশ্য এখন প্রকাশ পাড়ুকোনকে অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোন-এর বাবা হিসাবেই চিনতে হয়। অথচ দীপিকা পাড়ুকোনের বলিউডে আত্মপ্রকাশ হয়েছিল ২০০৭ সালে, ‘ওম শান্তি ওম’ দিয়ে, যখন প্রকাশ ৫২ বছর বয়সের ক্রসকোর্ট লাইন পেরিয়ে এসেছেন। দীপিকার ব্যাডমিন্টনখ্যাত বাবার জন্ম হয়েছিল ব্যাঙ্গালুরুতে (তখন ব্যাঙ্গালোর), ৬৭ বছর আগের আজকের তারিখে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...