নতুন শুরু, নয়তো শেষ গর্জন

একসময় যেই দলটায় খেলে গেছেন অর্জুনা রানাতুঙ্গা, সনাথ জয়াসুরিয়া, কুমার সাঙ্গাকারা, মাহেলা জয়াবর্ধনে, দিলশান, লাসিথ মালিঙ্গা, মুত্তিয়া মুরালিধরন, রঙ্গনা হেরাথ - প্রমূখ গ্রেট ক্রিকেটাররা সেই দলের আজ বেহাল অবস্থা। ইনজুরি, বাজে ফর্ম, বার বার অধিনায়ক পরিবর্তন, ক্রিকেট বোর্ডে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সব মিলিয়ে একসময় বিশ্বক্রিকেট শাসন করা দলটার অবস্থা বিধ্বস্থ প্রায়!

সর্বশেষ এক বছরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ১৪ ম্যাচে লঙ্কানদের জয় মাত্র একটিতে! একটি পরিত্যক্ত আর একটি ড্র ছাড়া বাকি ১১ ম্যাচেই হার! একসময় বিশ্ব ক্রিকেটে গর্জন করা সিংহ যেন ঘুমিয়ে গিয়েছিল। ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ধবল ধোলাইয়ের পর মনে হচ্ছিলো লঙ্কান ক্রিকেটের সোনালী সময় হয়তো আর ফিরবে না! ২২ গজে কি তাহলে আর সিংহের গর্জন শোনা যাবে না?

একসময় যেই দলটায় খেলে গেছেন অর্জুনা রানাতুঙ্গা, সনাথ জয়াসুরিয়া, কুমার সাঙ্গাকারা, মাহেলা জয়াবর্ধনে, দিলশান, লাসিথ মালিঙ্গা, মুত্তিয়া মুরালিধরন, রঙ্গনা হেরাথ – প্রমূখ গ্রেট ক্রিকেটাররা সেই দলের আজ বেহাল অবস্থা। ইনজুরি, বাজে ফর্ম, বার বার অধিনায়ক পরিবর্তন, ক্রিকেট বোর্ডে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সব মিলিয়ে একসময় বিশ্বক্রিকেট শাসন করা দলটার অবস্থা বিধ্বস্থ প্রায়!

তবুও আরেকবার মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছে। উইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে হটাৎ ক্যারিবিয়ান দ্বীপে জেগে উঠে ঘুমন্ত সিংহ! ২-১ এ টি-টোয়েন্টি সিরিজ হারের পর ৩-০ তে ওয়ানডেতে হোয়াইটওয়াশ। হারের বৃত্তটা যেনো ক্রমাগত বাড়ছেই – এরপর টেস্ট সিরিজ।

লংকান ক্রিকেটের এমন দূরাবস্থায় সিরিজ হার টা ‘প্রায়’  আশঙ্কা করাই যাচ্ছিলো। কিন্তু হটাৎ ঘুমিয়ে থাকা সিংহের গর্জনের চেষ্টা! উইন্ডিজের বিপক্ষে দুই টেস্টেই দূর্দান্ত লড়াই করে সিরিজ ‘ড্র’। দুই ম্যাচেই জয়ের কাছাকাছি ছিলো লংকানরা, প্রথম টেস্টে তো মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে সেখান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জয়ের দ্বারপ্রান্তে গিয়েও জিততে পারেনি! আর দ্বিতীয় টেস্টে সিংহের মতো লড়াই করে আদায় করে নিয়েছে ড্র।

এবার দুই টেস্ট নিয়ে একটু বোঝার চেষ্টা করি।

প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে লাহিরু থিরিমান্নের ৭০ রানের ইনিংসের পরেও রোচ-হোল্ডারদের বোলিং তোপে মাত্র ১৬৯ রানে অলআউট হয় শ্রীলঙ্কা! জবাবে প্রথম ইনিংসে লাকমলের ফাইফরে ২৭১ রানে থামে ক্যারিবিয়ানদের ইনিংস। দ্বিতীয় ইনিংসে ৯৮ রানে তখন পিছিয়ে সফরকারীরা! রোচ-হোল্ডারদের সামনে ইনিংস ব্যবধানে হারের শঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছিলো না।

কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে সেই লিড টপকে থিরিমান্নের ৭৬, ওসাদে ফার্নান্দোর ৯১, সিলভার ৫০, ডিকভেলার ৯৬ আর পাথুম নিসাকার মেইডেন সেঞ্চুরিতে ক্যারিবিয়ান দ্বীপে গর্জে ওঠে লংকানরা! হারের শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে লিড টপকে ক্যারিবিয়ানদের সামনে ৩৭৮ রানের বড় লক্ষ্যমাত্রা ছুঁড়ে দেয় লংকানরা। তবে বোনারের মেইডেন সেঞ্চুরি আর কাইল মায়ার্সের ফিফটিতে শেষ পর্যন্ত প্রথম টেস্ট ড্র হয়!

শেষ কবে এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ার পর লংনরা ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো মনে আছে কি? নিশ্চিত হারা ম্যাচ ঘুড়িয়ে দিয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করা! তবে কি সিংহ আবারো জেগে উঠেছে?

দ্বিতীয় টেস্টেও একই কাণ্ড! উইন্ডিজের করা প্রথম ইনিংসে ৩৫৪ রানের বিপরীতে প্রথম ইনিংসে মাত্র ২৫৮ রানেই অলআউট শ্রীলঙ্কা। বল হাতে লাকমলের ৪ উইকেট, আর ব্যাট হাতে থিরিমান্নের ফিফটি এই ইনিংসেও! ৯৬ রানে এগিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে ৪ উইকেটে ২৮০ রানে ইনিংস ঘোষণা করে ক্যারিবিয়ানরা। লঙ্কানদের সামনে লক্ষ্যমাত্রা ৩৭৬ রান, উইন্ডিজের হাতে আছে একদিনেরও বেশি সময়! রোচ-হোল্ডাররা যেভাবে প্রতি ইনিংসেই লংকান শিবিরে তোপের আঘাত হানছেন সে হিসেবে ম্যাচে তখনও ফেবারিট উইন্ডিজই।

কিন্তু সিংহ যে আবারো জেগে উঠেছে বুক চিতিয়ে লড়াই করতে! থিরিমান্নে-করুনারত্নের ১০১ রানের ওপেনিং জুটি সেটারই ইঙ্গিত দেয়। থিরিমান্নে ৩৯ রানে ফিরলেও অধিনায়কের ১৭৬ বলে ৭৫ আর ওসাদে ফার্নান্দোর ধৈর্য্যশীল ৬৬ রানে ম্যাচ বাঁচায় লংকানরা। শেষ দিনে উইকেট বাঁচিয়ে ৭৯ ওভার ক্রিজে টিকে থাকেন লঙ্কানরা! রোচ-হোল্ডারদের বোলিং তোপ, কিংবা রাখিম কর্ণওয়ালের৷ ঘূর্নি কিছুতেই পরাস্থ হননি লংকান টপ অর্ডার!

হারের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে চাপের মুখে সিরিজের দুই টেস্টই ড্র করতে সক্ষম হয় লঙ্কানরা। ৬৮ মাস পর সিরিজের দুই টেস্টই ড্র হয়! সবশেষ ২০১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম বাংলাদেশের মধ্যকার টেস্ট সিরিজের দুই ম্যাচই ড্র হয়। অবশ্য সেটা বৃষ্টির কল্যাণেই!

রোচ-হোল্ডার, জোসেফ-কর্ণওয়ালদের সামনে থিরিমান্নের পুরো টেস্ট সিরিজেই দূর্দান্ত ব্যাটিং, লাকমলের সিরিজ সেরার পুরষ্কার, অভিষিক্ত নিসাকার সেঞ্চুরি, তিন নম্বরে ওসাদের কামব্যাক আর ডিকভেলার সময়োপযোগী ইনিংস! সব মিলিয়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপে লংকানরা প্রমাণ করলো তারা হারিয়ে যাননি।

একসময় বিশ্ব ক্রিকেট শাসন করা সেই শ্রীলঙ্কা হয়তো আর ফিরবে না! শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের স্বর্ণালী যুগের হয়তো অবসান হয়েছে। কিন্তু ক্যারিবিয়ান দ্বীপে ঘুমিয়ে থাকা সিংহের হঠাৎ গর্জন প্রমাণ করে তারা ফুড়িয়ে যাননি! আর সম্প্রতিই শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের (এসএলসি) ডিরেক্টর অব ক্রিকেট হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন টম ‍মুডি, ফলে বোঝা যাচ্ছে বোর্ডও হাল ছাড়েনি। হয়তো আবারো ২২ গজে শোনা যাবে সিংহের গর্জন, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে একের পর এক জয় ছিনিয়ে আনবে। হয়তো এটাই নতুন শুরু, নয়তো শেষ গর্জন!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...