রোনালদো, মুক্তির ময়দানে ব্রাজিলের সাথে

২০০২ বিশ্বকাপ ফুটবল, বিশ্ব ফেলে এসেছে দুই দশক আগে। কিন্তু সে সব দৃশ্য বা স্মৃতি যেন এখনো তাজা। একজন ফুটবলার ডিফেন্ডারদের বোকাবনে পাঠিয়ে বল নিয়ে কারিকুরি করে চিপ কিংবা গোল রক্ষকের ওভার দ্য হেডে বল পাঠিয়ে নিখুঁত ফিনিশিং দিচ্ছে, সাথে নিষ্কলুষ মুক্তঝরা হাসি দিয়ে উদযাপনের মাধ্যমে পুরো মাঠের দর্শকদের উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে দিচ্ছেন- এর চাইতে শ্বাশত, সুন্দর দৃশ্য আর কিইবা হতে পারে। 

২০০২ বিশ্বকাপ জয়ী দল ব্রাজিলের একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে। নাম ‘পেন্টা’। এ গ্রুপের মাধ্যমে দুই দশক আগে জেতা সেই বিশ্বকাপ স্কোয়াডের সদস্যদের মধ্যে এখনও কথা হয়। জাপান ও কোরিয়ায় হওয়া সে বিশ্বকাপের পথযাত্রা নিয়ে এখনও স্মৃতি রোমন্থন করেন কাফু, রোনালদো, রিভালদো কিংবা রবার্তো কার্লোসরা। 

ব্রাজিলের পঞ্চম এবং এখন পর্যন্ত শেষ সেই বিশ্বজয়ের নেপথ্যে অন্যতম ছিলেন দ্য নাম্বার নাইন রোনালদো। সেবারের আসরে তিনি একাই করেন ৮ গোল। আর সেমিফাইনাল, ফাইনাল মিলে ব্রাজিল যে সর্ব মোট তিনটি গোল দিয়েছিল তার সবগুলোই এসেছিল রোনালদোর পা থেকে। ৯৮ এর বিশ্বকাপে গোল্ডেন বল পাওয়া রোনালদো ২০০২ এর বিশ্বকাপে পান গোল্ডেন বুট। 

১৯৯৮ এর বিশ্বকাপ রোনালদোর জন্য মিশ্র এক অনুভূতির নাম। ফাইনালের আগে ব্রাজিলের করা ১৪ গোলের ৭ টিতেই ছিল রোনালদোর অবদান। চার গোল আর তিন অ্যাসিস্টে রীতিমত সে আসরে উড়ছিলেন তিনি। কিন্তু ফাইনালে ম্যাচে এসেই নিষ্প্রভ এক রোনালদোকে দেখে বিশ্ববাসী। জিনেদিন জিদানের নৈপুণ্যে সেবারে বিশ্বকাপটি জিতে নেয় ফ্রান্স। আর এদিকে টানা দুই বিশ্বকাপ শিরোপার খুব কাছে গিয়েও সে কীর্তি স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয় ব্রাজিল। সেই বিশ্বকাপে টুর্নামেন্ট সেরা ফুটবলার হয়েছিলেন রোনালদো দ্য লিমা। কিন্তু ফাইনাল হারের জন্য পুরো ব্রাজিলবাসীর কাছেই তিনি হয়ে যান খলনায়ক। 

অবশ্য পরে জানা যায়, ফাইনালের আগের দিন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন রোনালদো। তাঁকে হাসপাতালেও ভর্তি করা হয়। কোচ মারিও জাগালো তাঁকে ফাইনালের একাদশ থেকে প্রথমে বাদও দিয়েছিল। কিন্তু রোনালদোর প্রবল আগ্রহে শেষ পর্যন্ত তাঁকে একাদশে অন্তর্ভূক্ত করতে বাধ্য হন। আনফিট রোনালদো সেদিন অনেকটা জেদের বশেই মাঠে নেমেছিলেন। কিন্তু মাঠের মধ্যে নিজের সীমাবদ্ধতাও টের পেতে শুরু করেন পরে। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে যিনি আলো ছড়িয়েছিলেন সেই রোনালদো ফাইনাল ম্যাচে আবদ্ধ হয়ে রইলেন অসহায়ত্বের আবেশে। 

৯৮ এর বিশ্বকাপ রোনালদোকে ব্যথিত করেছিল। তার উপর গোল্ডেন বল পেয়েও সমালোচনা তাঁর পিছু ছাড়ছিল না। রোনালদোও তাই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। নিজের ভিতর থাকা সমস্ত বারুদ জমিয়ে রেখেছিলেন ২০০২ বিশ্বকাপের জন্য। 

২০০২ বিশ্বকাপ জয়ের গল্পে পরে যাওয়া যাক। তার আগে রোনালদোর উত্থানের গল্পে দৃষ্টি দেওয়া যাক। ছোটবেলা থেকেই রোনালদোর প্রিয় ক্লাব ফ্লামিঙ্গো। দু’চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে একবার ফ্লামেঙ্গোতে খেলার জন্য ট্রায়ালেও গিয়েছিলেন। কিন্তু ফ্লামেঙ্গোর সেবার ১৫ বছর বয়সী রোনালদোকে মনে ধরেনি। রোনালদো সুযোগ পেলেন না তাঁর স্বপ্নের ক্লাবে। তবে তাঁকে অনেক বড় স্বপ্নের পথে এগিয়ে দিল ক্রুইজেরো।

ক্রুইজেরোর হয়ে নিজের প্রথম মৌসুমেই দারুণ ছন্দে ছিলেন রোনালদো।প্রথম মৌসুমেই জিতে নেন ক্লাব ইতিহাসে প্রথম ব্রাজিলের ঘরোয়া টুর্নামেন্ট কোপা ডে ব্রাজিল। কোপা ডে ব্রাজিল ক্রুইজেরোর হয়ে ১৪ ম্যাচ করেছিলেন ১২ গোল। হয়েছিলেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা। সব মিলিয়ে ক্রুইজেরোর হয়ে সে মৌসুমে রোনালদো ৪৭ ম্যাচে করেছিলেন ৪৪ গোল।

ক্রুইজেরোর হয়ে দুর্দান্ত এক মৌসুমই নতুন মোড় এনে দেয় রোনালদোর ক্যারিয়ারে। মাত্র ১৮ বছরেই সুযোগ পান ১৯৯৪ বিশ্বকাপ ব্রাজিল দলে। তবে সুযোগ মিলল না কোন ম্যাচে। কারণটাও খুবই সাধারণ। ব্রাজিলের তখনকার সেরা স্ট্রাইকার রোমারিও। রোমারিওকে বাদ দিয়ে তাই নবাগত স্ট্রাইকার রোনালদোকে একাদশে নামানোর সুযোগই নেই। তবে দুই যুগ পর সেবার ব্রাজিল বিশ্বকাপ জেতায় ঐতিহাসিক এক মুহূর্তের সঙ্গী হন রোনালদো।

বিশ্বকাপ জেতার বছরেই ক্রুইজেরো ক্লাব ছেড়ে ইউরোপে পাড়ি জমান রোনালদো। সতীর্থ রোমারিওর পরামর্শে যোগ দেন নেদারল্যান্ডসের ক্লাব পিএসভি-তে। ইউরোপে নিজের প্রথম মৌসুমে এসেই বাজিমাত করেন তিনি। ডাচ লিগের এক মৌসুমেই করলেন ৩০ গোল। তবে পরের মৌসুমেই ইনজুরিতে পড়েন তিনি। আর ওই ইনজুরিতেই সে মৌসুমে বেশিরভাগ সময় মাঠের বাইরে কাটাতে হয় তাঁকে। তবে ঠিকই চমক দেখিয়েছিলেন ডাচ কাপে। ১২ ম্যাচে ১৩ গোল করে পিএসভিকে সেবার এনে দিয়েছিলেন ডাচ কাপের শিরোপা। 

পিএসভির হয়ে দুই মৌসুমে ৫৮ ম্যাচে করেছিলেন ৫৪ গোল। পিএসভির হয়ে নজরকাড়া পারফরম্যান্সের পর রোনালদো নজরে পড়ে যান স্প্যানিশ জায়ান্ট বার্সেলোনার চোখে। এর সাথে ইন্টার মিলানও উঠে পড়ে লাগে রোনালদোকে দলে ভেড়াতে। তবে শেষ পর্যন্ত ১৭ মিলিয়ন পাউন্ডে পিএসভি থেকে বার্সেলোনায় যোগ দেন রোনালদো।

রোনালদো বার্সায় যোগ দেন ১৯৯৬-৯৭ মৌসুমের শুরুতে। আর সে বছরেই মাত্র ২০ বছর বয়সে সবচেয়ে কম বয়সী খেলোয়াড় হিসেবে ফিফা প্ল্যেয়ার অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড জেতার রেকর্ড গড়েন তিনি। বার্সা খেলোয়াড় হিসেবে সে পুরস্কার গ্রহন করলেও রোনালদো ফিফা বর্ষসেরা হয়েছিলেন মূলত পিএসভি’র হয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের জন্য। 

বার্সায় এসে রোনালদো প্রথম মৌসুমেই যা করলেন তা রীতিমত অবিশ্বাস্য। ৪৯ ম্যাচেই করলেন ৪৭ গোল। এর মধ্যে লা লিগাতেই করলেন সে মৌসুমের সর্বোচ্চ ২৫ গোল। সে মৌসুমেই এসডি কম্পোস্টেলার সাথে রোনালদো এমন গোল করলেন যে স্প্যানিশ পত্রিকা এ এস শিরোনামই দিয়ে ফেলল এক মহাতারকার নামে, ‘পেলে রিটার্নস’। স্পেনে তখন রোনালদোকে নিয়ে রব রব উৎসব।  কিন্তু বার্সার সাথে চুক্তি নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় পরের মৌসুমেই দল ছাড়েন তিনি।

১৯৯৪ এর বিশ্বকাপে ব্রাত্য থাকা রোনালদো ৯৮ এর বিশ্বকাপে দলের একদম প্রাণভোমরা। ব্রাজিল দলের সাবেক ফুটবলার মাতে সাভিও তো বলেছিলেন, রোনালদো তখন প্রতিপক্ষের জন্য ছিল রীতিমত ভয়ানক এক ফুটবলার। সে মাঠে তাঁর পছন্দ মত সব কিছু করার সক্ষমতা রাখে। ৯৮ এর আগেই সে বিশ্বের সেরা নাম্বার নাইন হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দুর্দান্ত খেলা রোনালদো হঠাৎই ফাইনালের দিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেদিন দুপুরের খাবার খাওয়ার পর তিনি মিনিট দুয়েক অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। রোনালদোকে এমন অবস্থায় প্রথম আবিষ্কার করেন কাফু।

হোটেল রুমের সেই ভয়াবহতা নিয়ে পরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। কারণ সে আমাদের দলের সেরা প্লেয়ার। সে আমাদের সাথে সেদিন বাসে যেতে পারেনি। হসপিটাল থেকে সোজাসুজি স্টেডিয়ামে এসেছিল। মেডিকেল টিম থেকে তাঁর খেলার বারণ ছিল। কিন্তু রোনালদো তাদের অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে শেষ পর্যন্ত মাঠে নামে। তবে রোনালদো সে ম্যাচে ফিট ছিল না। কে জানে, সে যদি ঐদিন ১০০% ফিট থাকত তাহলে আমরা ম্যাচটা জিততে পারতাম।’

১৯৯৮ বিশ্বকাপ হারের পরে রোনালদোর সময়টা কেটেছিল বেশ বাজে। এর উপর ৯৯-এর নভেম্বরে তিনি ডান পায়ের হাঁটুর ইনজুরিতে পড়েন। যার কারণে তাঁকে দীর্ঘ ৫ মাস মাঠের বাইরে কাটাতে হয়েছিল। কিন্তু ছয় মাস পরে মাঠে প্রত্যাবর্তনের দিনে আবারও ইনজুরিতে পড়েন তিনি। আর এই ইনজুরিটি ছিল আগের চেয়ে আরও ভয়াবহ। রোনালদো তখন ইন্টারে খেলতেন। 

ইন্টারের সে সময়ের ফিজিওর মতে, রোনালদোর সেই ইনজুরির অবস্থা এতটাই বাজে ছিল যে, তাঁকে সেরে উঠতে রীতিমত একটা অলৌকিক ব্যাপার ঘটা লাগতো। সে সময়ে তাঁর ২০০২ বিশ্বকাপ খেলাও নিছক একটা স্বপ্নের মত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। 

আট মাস পরে কিছুটা সুস্থবোধ করেন রোনালদো। তারপরও তিনি তাঁর হাঁটু নড়াতে পারতেন না। রোনালদো এবার স্বেচ্ছাতেই পুনর্বাসনে যান। কারণ তাঁর চোখমুখ জুড়ে ছিল ২০০২ বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন। কারণ আগের বিশ্বকাপ হারের ক্ষত তখনও তিনি ভোলেননি। 

পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মধ্যে রোনালদো নিজে থেকে পরিশ্রম করতে লাগলেন। প্রতিদিন ৯ ঘন্টা করে সময় দিতেন ব্যক্তিগত কন্ডিশন ক্যাম্পের পেছনে। এর ফলও মিলতে শুরু করে আস্তে আস্তে। ২০০১ এর নভেম্বরের দিকে তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন। ইন্টারের হয়ে মাঠেও ফেরেন দ্রুতই। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! বিশ্বকাপ শুরুর মাস দুয়েক আগে তিনি আবার ইনজুরিতে পড়েন। এবার তিনি মাঠের বাইরে চলে যান হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে পড়ে। 

বিশ্বকাপের আগে এমন ইনজুরি। স্বভাবতই বিশ্বকাপে রোনালদোকে আর না দেখার শঙ্কা। কিন্তু রোনালদো খুব তাড়াতাড়ি সে ইনজুরি থেকে নিজেকে রিকোভারি করে ফিরে এলেন। এসেই সিরিআ তে ৫ ম্যাচে দিলেন ৪ গোল। 

ব্রাজিলের কোচ তখন লুইজ স্কলারি। রোনালদোর প্রতি তাঁর শুরু থেকেই বিশ্বাস ছিল। ইনজুরির সময় পাশেও ছিলেন তিনি। তাই ২০০২ বিশ্বকাপ স্কোয়াডেও অবশেষে জায়গা মিললো রোনালদোর। 

রোনালদো কতটা বিশ্বকাপ খেলার জন্য উদগ্রীব ছিল তা জানা যায় তাঁর সতীর্থ ফুটবলার কাফুর আছে। কাফু এক সংবাদ মাধ্যমে বলেছিলেন, ‘রোনালদো সব সময় বিশ্বকাপ খেলতে চাইত। সে সব সময় দেখাতে চাইত, তাঁর সক্ষমতা আছে। আর ব্রাজিল দলে ফিরে আসার জন্য কঠিন পরিশ্রম করত।’ 

অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে রোনালদোর অবশেষে বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু হল। কিন্তু সেবারের আসরে তিনি পাশে পেলেন না তাঁর আইডল রোমারিওকে। কারণ কোচ স্কলারি রোমারিওকে বাদ রেখেই দল ঘোষণা করেছিল। 

ব্রাজিলের প্রথম ম্যাচ তুরস্কের সাথে। সে বারের বিশ্বকাপে ব্রাজিল দলের অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এমারসনকে। কিন্তু ট্রেনিংয়ের সময় তিনি কাঁধে চোট পেয়ে টুর্নামেন্ট থেকেই ছিটকে যান। এরপর কোচ স্কলারি কাফুকে অধিনায়কত্বের আর্ম ব্যান্ড তুলে দেন। 

তুরস্কের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে আক্রমণ ভাগে ছিলেন রোনালদো, রোনালদিনহো আর রিভালদো। এমন আক্রমণ ত্রয়ীতে খুব সহজেই তুরস্ককে হারিয়ে দেওয়ার দিকেই চোখ ছিল সবার। কিন্তু প্রথমার্ধের শেষ মুহূর্তে গিয়ে গোল হজম করে বসে ব্রাজিল। গোল করেন তুরস্কের হাসান সুকুর। 

তবে ড্রেসিংরুমে এসে বিরতির সময় মাথা ঠান্ডা রেখে পরের অর্ধ ভাল খেলার দিকে মনোনিবেশ করার নির্দেশ দেন কোচ স্কলারি। ঠিক কোচের কথা মত কাজ। ৫০ মিনিটেই রোনালদোর গোলে সমতায় আসে ব্রাজিল। আর ৮৭ মিনিটে গিয়ে পেনাল্টি থেকে গোল করে ব্রাজিলকে এগিয়ে দেন রিভালদো। শুরুর ধাক্কা সামলে স্কলারির দল ঠিকই শেষ পর্যন্ত ম্যাচ জিতে মাঠ ছেড়েছিল। আর সে ম্যাচের পর রোনালদোর নিজের গোল নিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা কেবল শুরু। আশা করছি সামনে আরও গোল পাব। সেই সব মুহূর্ত সামনে আসছে।’ 

তুরস্কের পর এবার চীন বাঁধা। ব্রাজিল সেটা টপকে গেল অনায়াসেই। গুণে গুণে চারখানা গোল তারা জড়ালো চীনের গোলপোস্টে। এ ম্যাচেও গোল পেলেন রোনালদো। আর গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে কোস্টারিকার বিপক্ষে তিনি একাই দিলেন দুই গোল। ব্রাজিল সে ম্যাচ জিতল ৫-২ গোলে। 

গ্রুপ পর্বের খেলা শেষে রোনালদো ৩ ম্যাচে ৪ গোল। অর্থাৎ আগের বিশ্বকাপ আসরের মত ৪ গোল তিনি এরই মধ্যে করে ফেললেন। এখন সেটাকে ছাপিয়ে যাওয়ার পালা। রাউন্ড অফ সিক্সটিনের ম্যাচেই তিনি সেটাকে ছাপিয়ে গেলেন। বেলজিয়ামে বিপক্ষে ২-০ গোলের জয়ে ৮৭ মিনিটে গোল পান রোনালদো। আর এর মধ্য দিয়ে ব্রাজিল উঠে যায় কোয়ার্টার ফাইনালে। 

কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। সেবারের বিশ্বকাপে শুধু এই একটি ম্যাচেই গোল পাননি রোনালদো। তবে রিভালদো আর রোনালদিনহোর গোলে ঠিকই জিতেছিল ব্রাজিল। যদিও ম্যাচের ২৩ মিনিটে ইংল্যান্ডের গোলে প্রথমে পিছিয়ে পড়েছিল ব্রাজিল। তবে শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি জিতে সেমিতে পৌঁছে যায় স্কলারির দল। 

সেমিফাইনালে আবারও সেই তুরস্ক বাঁধা। বিশ্বকাপ থেকে আর দুই ধাপ পেছনে দুই দল। তাই ফেবারিটের তকমা ব্রাজিলের গায়ে থাকলেও ম্যাচজুড়ে বিরাজ করেছিল টানটান উত্তেজনা। প্রথমার্ধ গোলশূণ্য থেকেই শেষ হয়। তবে পরের অর্ধের শুরুতেই গোল করে ব্রাজিলকে এগিয়ে দেন রোনালদো। আর ঐ একমাত্র গোলেই টানা তৃতীয়বারের মত বিশ্বকাপ ফাইনালে যায় ব্রাজিল।  

ফাইনালে ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ টুর্নামেন্টের অন্যতম ফেবারিট দল জার্মানি। ব্রাজিলের আক্রমণ ভাগ যতই শক্তিশালী জার্মানি তখন পর্যন্ত গোল হজম করেছে মাত্র একটি। সে বারের আসরে জার্মান গোলরক্ষক অলিভার কান একেবারে হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিরোধ্য। ফাইনাল ম্যাচের শুরুতেও সেই ধাঁচ পাওয়া গেল। মুহুর্মুহু আক্রমণেও জার্মান গোলপোস্ট লক্ষ্যভেদ করা যাচ্ছিল না।

অবশেষে ৬৭ মিনিটে রোনালদোর গোল থেকে এগিয়ে যায় ব্রাজিল। আগের বিশ্বকাপের ফাইনালের স্মৃতি সেদিন রোনালদোকে রীতিমত তাঁতিয়ে দিয়েছিল। পুরো টুর্নামেন্টে মাত্র একটি গোল হজম করা অলিভার কান ফাইনালে এসে রোনালদোর কাছেই হজম করলেন ২ গোল। ম্যাচের ৭৯ মিনিটে দ্বিতীয় গোলের দেখা পান রোনালদো। আর সেই স্কোর লাইন রেখেই পঞ্চম বারের বিশ্বকাপ জয়ের কীর্তি গড়ে ব্রাজিল। 

বিশ্বকাপ জেতার পর অন্য এক জগতে হারিয়ে গিয়েছিলেন রোনালদো নিজেই। ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলেন না অবিশ্বাস্য এই মুহূর্ত। ম্যাচ শেষে রোনালদোর কন্ঠেও অবিশ্বাস্য মাখা সুর ভেসে আসলো। তিনি বললেন, ‘আমি আসলে ধীরে ধীরে বোঝার চেষ্টা করছি কী হয়েছে। আমি আমার আবেগ এই মুহূর্তে বুঝাতে পারছি না। আমি সব সময়ই বলে এসেছি, আমার ইচ্ছা শুধু ফুটবল খেলা, গোল করা, আর দলকে ম্যাচ জেতানো। এটা আমাদের পঞ্চম শিরোপা। এটা আমাদের পুরো দলের জয়। আর এর আনন্দ আমার ইনজুরি থেকে সেরে ওঠার চেয়েও অনেক।’ 

এটা আসলেই অনবদ্য। একজন ফুটবলার বিশ্বকাপের আগে টানা তিন বছর ইনজুরিতে লড়াই করেছেন। অনেকের ক্যারিয়ারের সমাপ্তি সেখানেই হতে পারতো। কিন্তু রোনালদো শুধু নিজের লক্ষ্যের পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন, দারুণ একটা স্বপ্ন এঁকেছিলেন। রোনালদোর সেই অঙ্কিত স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত পূরণ হয়েছিল। মানুষের দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তনের সাথে পৌরাণিক ফিনিক্স পাখির যে আখ্যা দেওয়া হয়, সেটি সবচেয়ে মানানসই তো রোনালদোর ২০০২ বিশ্বকাপ জয়ের সাথে। 

২০০২ বিশ্বকাপ ফুটবল, বিশ্ব ফেলে এসেছে দুই দশক আগে। কিন্তু সে সব দৃশ্য বা স্মৃতি যেন এখনো তাজা। একজন ফুটবলার ডিফেন্ডারদের বোকাবনে পাঠিয়ে বল নিয়ে কারিকুরি করে চিপ কিংবা গোল রক্ষকের ওভার দ্য হেডে বল পাঠিয়ে নিখুঁত ফিনিশিং দিচ্ছে, সাথে নিষ্কলুষ মুক্তঝরা হাসি দিয়ে উদযাপনের মাধ্যমে পুরো মাঠের দর্শকদের উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে দিচ্ছেন- এর চাইতে শ্বাশত, সুন্দর দৃশ্য আর কিইবা হতে পারে। 

 

রোনালদোর সেবারের বিশ্বকাপে প্রভাবটা কেমন ছিল তা প্রত্যেকটা ম্যাচের চিত্র দেখলেই বোঝা যায়। একটি ম্যাচ বাদে প্রত্যেকটি ম্যাচেই গোল করেছিলেন। ৮ গোল করে হয়েছিলেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা। তবে মাঠের বাইরের প্রভাবটাও ছিল অন্য রকম। ২০০২ বিশ্বকাপে অদ্ভুত এক হেয়ারকাটে মাঠে নেমেছিলেন রোনালদো। আর সেই হেয়ারকাটই অনুসরণ করতে শুরু করে পুরো বিশ্বের লক্ষ কোটি সমর্থক।

রোনালদো পরে এমন হেয়ারকাটের জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু ২০০৬ বিশ্বকাপেও রোনালদোর সেই হেয়ারকাটে দেখা গিয়েছিল তাঁর অজস্র ফ্যানকে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ব্রাজিলিয়ান বেশ কিছু ভক্তের চুলেও দেখা যায় রোনালদোর মত কাট। সেসব অনুকরণের দৃশ্য হয়তো অদ্ভুত ছিল। কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তিনি গোটা একটা প্রজন্মের বুকের ধরণীতে বাস করেছিলেন।

এমন হবেই বা না কেন? এখন পর্যন্ত তিনিই তো তর্ক-সাপেক্ষে সর্বকালের সেরা নাম্বার নাইন, অনেক ক্ষেত্রে সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপ ফুটবলারও।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...