সব সমস্যার সমাধান, সাকিব আল হাসান

আর্লি উইকেট দরকার? সাকিব আছেন। ব্রেকথ্রু দরকার? সাকিব আছেন। ইকোনোমিক্যাল বোলার দরকার? সাকিব আছেন। দ্রুত কিছু রান তোলা দরকার? সাকিব আছেন। পার্টনারশিপ দরকার? সাকিব আছেন। অধিনায়ক দরকার? সাকিব আছেন। যেকোন পজিশনে পারফেক্ট ব্যাটসম্যান চান? তিন নম্বরে ব্যাট করাতে চান? সাকিবকে পাবেন। যেকোন পিচে কার্যকরী বোলার চান? সেখানেও পাবেন সাকিবকে। যেখানেই সাকিব আল হাসান, সেখানেই সকল সমস্যার সমাধান।

সাকিব আল হাসান বর্তমান ক্রিকেটে একটি পারফেক্ট একাদশ সাজাতে একজন অলরাউন্ডার এর বিকল্প নেই, কারণ একটি টিম প্ল্যানিংয়ে একজন অলরাউন্ডার দলের অধিনায়কের বড় ভরসা হয়ে থাকেন, কারণ দুই ডিপার্টমেন্টেই সমানভাবে সার্ভিস দিতে পারেন তিনি।

বিশ্ব ক্রিকেট ইতিহাসে খোঁজ করলে অনেক কিংবদন্তি অলরাউন্ডারই পাওয়া যাবে, যারা অনেক অতিমানবীয় পারফরমেন্সের জন্য বিখ্যাত। কেউ কেউ সময়কে জয় করে নিজেকে নিয়ে গেছেন সর্বকালের সেরাদের কাতারে।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের গ্যারি সোবার্স, ভারতের কপিল দেব, পাকিস্তানের ইমরান খান, দক্ষিণ আফ্রিকার জ্যাক ক্যালিস, অস্ট্রেলিয়ার শেন ওয়াটসনরা নিজেদের দলের অনেক বড় সম্পদ হয়ে উঠছিলেন ক্রমেই।

নবীন বাংলাদেশও খুজছিল এমন কাউকেই যিনি এ দলটাকে পথ দেখাবেন, ব্যাটে-বলে পারফর্ম করে দলকে উজ্জীবিত করবেন। অলক কাপালি, মুশফিকুর রহমান বাবুরা আশা দেখালেও নিজেকে প্রস্ফুটিত করতে পারেননি কেউই।

ঠিক সেসময়টাতে ২০০৬ সালে অভিষেক হয় সাকিব আল হাসানের। কোঁকড়া চুলের বুদ্ধিদীপ্ত চোখের অধিকারী এই তরুণ প্রথম ম্যাচে ৩০ রান ও ১ উইকেট নিয়ে নিজের অলরাউন্ডিং প্রতিভার জানান দেন।

২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ভারত-বধে কৃপণ বোলিং ও ফিফটি করে সবার নজরে এসেছিলেন তিনি। ক্রমেই হয়ে উঠেছেন দলের প্রাণ ভোমরা। ২০০৮সালের নিউজিল্যান্ড সফরের আগে সাকিবকে ব্যাটসম্যান কাম পার্টটাইম অফ স্পিনার হিসেবেই গণ্য করা হতো কিন্তু রাজ্জাক-রফিকের অনুপস্থিতিতে কোচ জেমি সিডন্স সাকিবকে জেনুইন স্পিনার ঘোষণা দিয়ে দেন। কোচকে হতাশ করেননি সাকিব, প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৩৬ রানে নেন ৭ উইকেট যা দীর্ঘদিন টেস্টে বাংলাদেশি বোলারদের মধ্যে বেস্ট ফিগার ছিল।

নিউজিল্যান্ড এর আরেক বাঁহাতি অলরাউন্ডার ড্যানিয়েল ভেট্টোরির সাথে ব্যাটে-বলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেন সাকিব। কিন্তু ড্যানিয়েল ভেট্টোরির অভিজ্ঞতা সে টেস্টে ব্ল্যাক ক্যাপদের বিরুদ্ধে তিন উইকেটে জিতিয়ে দেয়। বাংলাদেশ ২-০ তে সিরিজ হারলেও, সাকিব ১৭.৮০ গড়ে ১০ টি উইকেট নিয়ে সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী হন।

পরের মাসেই বাংলাদেশ দল দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যায়। সাকিবের জয়রথ চলতে থাকে এখানেও। গুরু সালাহউদ্দিনের নির্দেশে তখন আয়ত্ত্ব করে নিয়েছেন ‘ফ্লাইট’। সেই ফ্লাইটেই কুপোকাত করেই প্রোটিয়াদের বিপক্ষে তুলে নেন পাঁচ উইকেট।

বিদেশের মাটিতে এই বোলিং প্রমাণ করে তিনি হারিয়ে যেতে নয়, জয় করতেই এসেছেন।

২০০৯ ছিল সাকিবের বিশ্বসেরা হবার বছর। আইসিসি অলরাউন্ডার র‌্যাংকিংয়ে উঠে আসেন এক নম্বরে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৬৯ বলে ৯২, সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ জেতানো তাঁকে এ সম্মান এনে দেয়।

আমরা তখন গর্ব করতে পেরেছিলাম, আমাদের কোনো খেলোয়াড় রাজত্ব করছেন সারা বিশ্বে। বাংলাদেশ প্রথমবারের মত এক নম্বর স্থানটিতে জ্বলজ্বল করলো তাঁর কল্যাণে। তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের প্রতীক।

আইসিসির র‍্যাংকিংগুলো চেঞ্জ হয় ঘনঘন। তীব্র প্রতিযোগীতার ফলে কেউ এক নম্বর হলে পরের সপ্তাহে তা ধরে রাখতে পারবেন কিনা তা নিশ্চিত বলতে পারাটাও মুশকিল!

কিন্তু সাকিব ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী, প্রায় ১.৫ বছর টানা থেকেছেন শীর্ষে। তিন ফরম্যাটেই হয়েছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার।

অনেকেই র‍্যাংকিং সেরা কিংবা পরিসংখ্যানের দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করলেও জাতীয় দলকে দিতে পারেন না যথেষ্ট সার্ভিস। এখানেই সাকিব আলাদা।

র‍্যাংকিংয়ে রাজত্ব কিংবা একের পর এক রেকর্ড গড়ে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারদের পাশে নাম লেখানো কোনটাই কিন্তু সাকিবকে ততটা উচ্ছোসিত করেনা যতটা করে জাতীয় দলকে প্রয়োজনীয় সাপোর্টটা দিতে পারলে। যে কাজটি পরম ভরসায় প্রায় ১৫-১৬ বছর ধরে করে যাচ্ছেন সাকিব আল হাসান।

হয়ে উঠেছেন অধিনায়কদের সেরা ভরসা, আর ভক্তদের কাছে সুপারম্যান সাকিব। ২০১৯ বিশ্বকাপে যেন ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন নিজের সেরা ফর্মেই। নিষেধাজ্ঞা তাঁর ক্যারিয়ে ছন্দপতন ঘটিয়েছিল বটে। তবে, সেটা বড় কোনো সমস্যা বলে প্রমাণিত হয়নি কালক্রমে। সাকিব ফিরেছেন তাঁর পুরনো রূপেই।

আর্লি উইকেট দরকার? সাকিব আছেন। ব্রেকথ্রু দরকার? সাকিব আছেন। ইকোনোমিক্যাল বোলার দরকার? সাকিব আছেন। দ্রুত কিছু রান তোলা দরকার? সাকিব আছেন। পার্টনারশিপ দরকার? সাকিব আছেন। অধিনায়ক দরকার? সাকিব আছেন।

যেকোন পজিশনে পারফেক্ট ব্যাটসম্যান চান? তিন নম্বরে ব্যাট করাতে চান? সাকিবকে পাবেন। যেকোন পিচে কার্যকরী বোলার চান? সেখানেও পাবেন সাকিবকে। যেখানেই সাকিব আল হাসান, সেখানেই সকল সমস্যার সমাধান।

হয়তো সমালোচক দৃষ্টিতে এখনি অবিসংবাদিত ভাবে সর্বকালের সেরাদের কাতারে বলা যাবেনা সাকিবকে। কিন্তু বাঘা বাঘা সেই লিজেন্ডরাও কি পেরেছিলেন সাকিবের মত একটি দলের হালচালই পালটে দিতে? দুঃসময়-সুসময়ে ড্রেসিংরুমের আত্মবিশ্বাস এর প্রধান উৎস হয়ে উঠতে? ভক্তদের এক চিলতে হাসি কিংবা লুকানো অশ্রুর প্রধান উৎস হয়ে উঠতে?

সমর্থকদের কাছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের রাজপুত্র তিনি। তাঁরা গর্বিত গলায় বলতেই পারেন, আমাদের হয়তো একজন গ্যারি সোবার্স নেই, কিন্তু সাকিব আল হাসান আছেন!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...