‘চেয়েছি আমার জন্য কেউ যেন দলে জায়গা না হারায়’

মার জীবনের সেরা হাইলাইটস হলো ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ছয় মেরে শিরোপা জয়। অর্জুনা রানাতুঙ্গা যখন ১৯৯৬ বিশ্বকাপে চার মেরে শিরোপা জেতে তখন আমার বয়স সাত বছর। সেখান থেকেই আমার ক্রিকেট জীবন শুরু। আমি শুরু থেকেই চেয়েছিলাম এমনভাবে উইনিং রান নিয়ে শিরোপা জিততে।

লঙ্কান অলরাউন্ডার থিসারা পেরেরা হঠাৎ করেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর ১২ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন এই ঘোষনার ভেতর দিয়ে।

ক্রিকেট বিষয়ক গণমাধ্যম ইএসপিএন ক্রিকইনফোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে থিসারা পেরেরা নিজের অবসর ও ক্রিকেট জীবন নিয়ে কথা বলেছেন। কেনো তিনি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে এমন সিদ্ধান্ত নিলেন, তার স্মরণীয় ইনিংস এবং ফ্র‍্যাঞ্জাইজি টুর্নামেন্ট নিয়ে তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী – এসব বিস্তারিত বলেছেন এই অলরাউন্ডার।

আপনার বয়স ৩২। কেনো এতো তাড়াতাড়ি অবসরের সিদ্ধান্ত নিলেন?

আমি শ্রীলঙ্কার হয়ে প্রায় ১২ বছর ক্রিকেট খেলেছি। আমি মনে করি এখন তরুণদের সুযোগ দেওয়া উচিত। বিশ্বকাপের আগে তরুনদের নিজেদের প্রস্তুত করতে সময়ের দরকার আছে। আপনি এটা (প্রস্তুতি) খুব তাড়াতাড়ি নিতে পারবেন না। ২০২৩ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপ আছে এবং অল্প কিছু মাস বাকি আছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের। বিশ্বকাপের কাছাকাছি সময়ে অবসর নেওয়ার চেয়ে ভালো এখনি কাউকে সুযোগ করে দেওয়া।

আপনি সম্ভবত শ্রীলঙ্কার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পরিকল্পনায় ছিলেন। তাহলে এই ফরম্যাটে কেনো অবসরের সিদ্ধান্ত নিলেন?

ওরা (বোর্ড) আমাকে তাঁদের পরিকল্পনা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানায়নি। যতটুক আমি শুনেছি তারা বেশ কিছু সিনিয়র খেলোয়াড়কে ওয়ানডে দল থেকে বাদ দিতে যাচ্ছে৷ তাই আমি মনে করেছি যেসব তরুণ খেলোয়াড় আমার বদলি ওয়ানডেতে সুযোগ পাবে, তারা টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটেও সুযোগ পাক। তাহলে সে সেট হওয়ার জন্য বেশ কিছু সময়ও পাবে। সে যদি বেশ কিছু ওয়ানডেও খেলে তাহলে তার জন্য যথেষ্ট সময় থাকবে বিশ্বকাপের আগে নিজেকে প্রস্তুত করা।

আপনি একজন বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটার। আপনার কি স্বপ্ন ছিলো না এটা (বিশ্বকাপ) আবার জেতার?

এটা আমি জিতেছি। আমি এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেও ভেবেছি যে আমি আরেকটা বিশ্বকাপ আনতে পারি। আমার জীবনের সেরা হাইলাইটস হলো ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ছয় মেরে শিরোপা জয়। অর্জুনা রানাতুঙ্গা যখন ১৯৯৬ বিশ্বকাপে চার মেরে শিরোপা জেতে তখন আমার বয়স সাত বছর। সেখান থেকেই আমার ক্রিকেট জীবন শুরু। আমি শুরু থেকেই চেয়েছিলাম এমনভাবে উইনিং রান নিয়ে শিরোপা জিততে। আমি এটা করার পর বেশ খুশি ছিলাম।

কিন্তু বর্তমান যে অবস্থা, এখনই সময় যে তারা (কর্তৃপক্ষ) তরুণদের দিকে নজর দিচ্ছে বেশ ভালোভাবে। আমি চিন্তা করেছি এ ব্যাপারে। আমি চেয়েছি আমার জন্য কেউ যেন দলে জায়গা না হারায়।

আপনি গত পাঁচ বছর ধরে টানা ম্যাচে সুযোগ পাননি। ২০১৭-১৮ তে আপনি সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের অধিনায়ক ছিলেন। আপনার কি সেটা নিয়ে বর্তমান সময়ে হতাশা কাজ করছে?

সবার জীবনেই পতন আসে। আপনার জীবনে যেমন উত্থান আসবে, তেমনি কিছু সময়ের জন্য পতনও আসে। এটা জীবনের সাধারণ একটা ব্যাপার। যখন আমি একটু হতাশ থাকি, আমি আমার সেরাটা দেই যাতে করে যেটা আমাকে নিচে নামাতে চাচ্ছে আমি যেনো সেটা থেকে দূরে থাকতে পারি। মাঝেমধ্যে এই বিষয়গুলো বেশ কাজে দেয়। আমি মনে করি আমি আমার দেশকে অনেক কিছু দিয়েছি। আমি বেশ কিছু রেকর্ডও করেছি।

২০১২ সালে আপনি এক ইনিংসে চার উইকেট নিয়েছিলেন এবং শ্রীলঙ্কার হয়ে খেলা শেষ টেস্টে ৭৫ রানও করেছিলেন। আপনি কি মনে করেন আপনার আরো সুযোগ পাওয়া উচিত ছিলো?

হ্যাঁ, আমি ওই টেস্টের পর আর টেস্ট ফরম্যাটে সুযোগ পাইনি। আমি এই ব্যাপারে খুব বেশি কিছু বলবো না। আমি বেশ কয়েক বছর দেখার পরই টেস্ট থেকে বিদায় নিয়েছি। আমি একটা সুযোগও পাইনি!

শ্রীলঙ্কার হয়ে খেলা আপনার সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতি কোনগুলো?

আমার ক্যারিয়ারের শুরুতে, আমি ২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনালটাই খুব ভালোবাসতাম। কারণ আমি আমাদের ইনিংসটা ছয় মেরে শেষ করেছিলাম। এরপর ২০১৪ বিশ্বকাপ শিরোপা জিতলাম সেটাও ছয় মেরে! আমি কখনোই সেটা ভুলবো না। প্রথম এশিয়ান ক্রিকেটার হিসেবে আমি ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে হ্যাট্রিক করি। এবং প্রথম লঙ্কান ক্রিকেটার হিসেবে ৬ বলে ৬ ছক্কা হাঁকাই প্রথম শ্রেনির ক্রিকেটে। আমি শ্রীলঙ্কার হয়ে সবচেয়ে বড় ছক্কা মেরেছি (পার্থ, ১২৩ মিটার)।

কোনো ইনিংস কিংবা স্পেল যেটা আপনার জন্য অনেক বড় কিছু?

হ্যাঁ, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২০১৯ সালে মাউন্ট মঙ্গানুইতে ১৪০ রান করি। আমি ৭ নম্বরে ব্যাট করতে নামি, ৩২০ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ২৫ ওভারে শ্রীলঙ্কার ১২১ রানে ৫ উইকেট ছিলো! আমি আমার ইনিংসের মাধ্যমে ম্যাচ জয়ের কাছাকাছি গিয়েছিলাম [যদিও ২১ রানে শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা হেরে যায়]।

আমি শ্রীলঙ্কার হয়ে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ছক্কা মারি সেদিন (১৩)। আমি বেশিরভাগ সময়েই টেইলএন্ডারদের সাথে ব্যাটিং করেছি। সেদিন নুয়ান প্রদীপ ছিলো আরেকপ্রান্তে এবং আমার মনে আছে আমি তাকে বলেছিলাম কোনো রকমে টিকে থাকতে, কারণ আমি আমার সেরাটা দিচ্ছিলাম ম্যাচ জিততে। আমরা খুব কম রানে হারি! হেরে যাওয়া দল থেকে ম্যাচ সেরা হতে খুব কমই দেখা যায়। কিন্তু আমি সেই ম্যাচে হয়েছিলাম।

এমন কিছু কি আছে যেটা আপনি অর্জন করতে চেয়েছেন কিন্তু পারেননি?

আমি যতটা সম্ভব করেছি। আমরা একটা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছি। ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতা আরেকটা স্বপ্ন ছিলো। আমার খেলা সাত বিশ্বকাপের মধ্যে ২০১১ বিশ্বকাপেই আমরা বেশ কাছে গিয়েও জিততে পারিনি, আমরা আমাদের সবটুকুই দিয়েছিলাম। আমাদের ভাগ্যে ছিলো না। কিন্তু আমি যা করার করেছি শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের জন্য। এখন আমি অবসর নিয়ে খুশি আছি।

আপনি শুরুতে বেশ কার্যকর বোলার ছিলেন। পরবর্তীতে সেটা আর দেখা যায়নি। আপনি কি সেটা নিয়ে হতাশ হন?

আমি তখন খুব ভালো বল করতাম শুরুতে। এরপর আমি সাইড স্ট্রেইন ইনজুরিতে পড়ি ২০১২ সালে এবং আমি আমার ব্যাটিংয়ে এরপর বেশি ফোকাস করি। আমি ১৪০ গতিতে বল করতে পারতাম, কিন্তু কারো যদি সাইড স্ট্রেইনে সমস্যা থাকে তাহলে সে বোলিং নিয়ে কিছুটা চিন্তায় থাকে, কারণ এটার ব্যাথাটা অনেক। আমার গতি কমানোর পরেও আমি বেশ ভালো উইকেট পাচ্ছিলাম। আমার ১৭৫টি ওয়ানডে উইকেট আছে এবং আমি তার সাথে ব্যাটিংটাও ভালো ব্যালেন্স করেছিলাম, ভালো ব্যাটও করছিলাম। আমি বোলিংয়ে যতটুক দেওয়ার ততটুকই দিতে পেরেছি বলে মনে করি।

অবসরের পর আপনার পরিকল্পনা কি?

আমি এখনো একজন পেশাদার ক্রিকেটার। ফ্র‍্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট আছে আমি একটা সময় পর্যন্ত সেটায় খেলবো। আমি শ্রীলঙ্কার আর্মির হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলি এবং আমি একজন আর্মি অফিসার। আমি এখন পুরো মনোযোগটা সেখানে দিতে পারবো। আমি আমার পরিবারের প্রতি আরো গুরুত্ব দিতে পারবো।

আপনি এলপিএলে জাফনা স্টোলিওনসের অধিনায়ক। আপনার জন্য ওই ফ্র‍্যাঞ্চাইজি কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

আমার সাথে আনান্দান আর্নোল্ডের (মালিক) কথা হয়েছে। আমরা গতবার বেশ ভালো করেছিলাম, টুর্নামেন্ট জিতেছিলাম। আমি মনে করি এবারও আমরা ভালো করবো। আমরা যেভাবে আলোচনা করেছি, আমি জাফনার হয়ে খেলা চালিয়ে যেতে চাই।

আর কিছু বলতে চান?

আমি কিছু মানুষকে ধন্যবাদ দিতে চাই। হার্শা ডি সিলভা সেন্ট জোসেফ কলেজে আমার কোচ ছিলো এবং সেখান থেকেই আমার জীবনের পরিবর্তনটা সবচেয়ে বেশি হয়৷ আমি সেখানে একজন ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতাম। এবং এরপর আমি ছয়ে ব্যাট করা শুরু করি এবং অলরাউন্ডার হিসেবে খেলার সুযোগ পাই। ২০০৯ সালে

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমার অভিষেক হয় এবং আমার মনে আছে কুমার সাঙ্গাকারা আমাকে খুব স্নেহ করতো, উনিই আমাকে দলে আনেন এবং তিনিই আমার প্রথম অধিনায়ক ছিলেন। আমি আমার বাবা-মাকে ধন্যবাদ দিতে চাই, আমার ভাই, বোন এবং স্ত্রী শিরামি পেরেরাকে, আমার ১২ বছরের ক্যারিয়ারে জাতীয় দলে যারা স্যাক্রিফাইস করেছে তাদেরকেও ধন্যবাদ দিতে চাই। আমি যখন খেলতে যেতাম শিরামি আমাকে ছাড়া মাসব্যাপিও একা থেকেছে। আমি আমার পরিবারের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...