জীবন একটা চকলেটের বাক্স

‘জীবন একটা চকলেটের বাক্স। কখন কি পাবে ঠিক নেই।’ - ফরেস্ট গাম্প সিনেমায় টম হ্যাংকস বেশ কয়েকবার বলেছেন কথাটা। সিনেমাপ্রেমীদের কাছে এই সিনেমা আর উক্তির মূল্য অনেকখানি। থমাস টুখেলের কাছেও হয়তো অনেক। শেষ ছয় মাসে তার উপর দিয়ে কম ঝড়-ঝঞ্ঝাট যায়নি।

২৩ আগষ্ট, ২০২০।

থমাস টুখেল লিসবনের স্তাদিও দ্য লুজে প্রবেশ করেছিলেন পায়ে ব্যান্ডেজ আর হাতে ক্র্যাচ নিয়ে। এমবাপ্পে, নেইমার, থিয়াগো সিলভাদের নিয়ে সাজানো পিএসজি দল নিয়ে মুখোমুখি হয়েছিলেন পরাক্রমশালী বায়ার্নের।

পুরো ম্যাচটা তাঁকে বসে থাকতে হয়েছে ডাগ আউটে, দরকার পরলে এগিয়ে এসে বাক্সের উপর বসে দলকে একের পর এক ইন্সট্রাকশন দিয়ে গিয়েছেন। ম্যাচটা শেষ হয়েছে টুখেলের অশ্রুতে!

২৯ মে, ২০২১।

থমাস টুখেল এই ম্যাচেও নেমেছিলেন নিজের চিরচারিত কালো ভেস্ট পরে। স্তাদিও দো দ্রাগোতে এবার নামলেন আনকোরা এক দল নিয়ে। মেসন মাউন্ট, টিমো ভের্নার, কাই হাভার্টজ; ফুটবল বিশ্বে এই মানগুলোর আলো ছড়ানো শুরু হয়েছে মাত্র।

আরো পড়ুন

সেই চেলসি, এই চেলসি

চেলসিকে বদলে দেওয়া পরশপাথর

ইউরোপের রং নীল!

পুরো ম্যাচটায় তাণ্ডব করলেন ডাগ আউটে, এই প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তে ছুটে বেরিয়েছেন। দিনশেষে অশ্রু জমা হয়েছে চোখের কোনায়, কিন্তু সে অশ্রু আনন্দের!

‘জীবন একটা চকলেটের বাক্স। কখন কি পাবে ঠিক নেই।’ – ফরেস্ট গাম্প সিনেমায় টম হ্যাংকস বেশ কয়েকবার বলেছেন কথাটা। সিনেমাপ্রেমীদের কাছে এই সিনেমা আর উক্তির মূল্য অনেকখানি। থমাস টুখেলের কাছেও হয়তো অনেক। শেষ ছয় মাসে তার উপর দিয়ে কম ঝড়-ঝঞ্ঝাট যায়নি।

কমকিছু সহ্য করতে হয়নি এই কয় দিনে। কিন্তু তার মাঝেও বিজয়ী বেশে বের হতে পারার আনন্দে যখন টুখেলের চোখ ভিজে যায়, ফুটবল সেখানেই পেয়েছে তার সৌন্দর্য্য!

মৌসুমের শুরুতে এই অবস্থার কথা দু:স্বপ্নেও ভাবেননি থমাস টুখেল। না শিরোপা উঁচিয়ে ধরার কথা বলছি না। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা উঁচিয়ে ধরবার কথা বললে সেটা নিয়ে হয়তো স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্ন দেখাটাই স্বাভাবিক ছিল। একপাশে এমবাপ্পে, অন্যপাশে ডি মারিয়া; মাঝে নেইমার-ইকার্দি।

এও দল নিয়ে যদি আপনি স্বপ্ন না দেখেন, তবে বলতেই হবে আপনার স্বপ্ন দেখায়, বড় কিছু ভাবনার সংকট আছে। টুখেলের সেটা ছিল না, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে একবার পারেননি তো আরেকবার পারবেন, সেই লক্ষ্যেই নতুন মৌসুম শুরু করেছিলেন তিনি।

কিন্তু মৌসুমটা তার স্বপ্নের সমান হয়নি। বরং মৌসুম যত গড়াতে থাকে তত দু:স্বপ্নে পরিণত হতে থাকে তার জন্য। নেইমার-এমবাপ্পে শুধু তারকা নয়, বরং দিনকেদিন হয়ে উঠছিলেন শাখের করাত। তাদের সামলানো সহজ কোনো কাজ নয়। সহজ কাজটা সহজে করতে পারেননি বলেই, হঠাৎ একদিন মুখ ফসকে বলে বসলেন, এখানে ফুটবল থেকে রাজনীতি সামলাতে হয় আমাকে বেশি।

ব্যাস। এমনিতেই আগে থেকে স্পোর্টিং ডিরেক্টরের সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে, এটি ছিল কফিনের শেষ পেরেক। ক্রিসমাসের দিন আনন্দের জায়গায় দুঃসংবাদ পেলেন থমাস টুখেল। চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে তাঁকে!

তাকে বলা যায় ইয়ুর্গেন ক্লপের যোগ্য শিষ্য। ক্লপের মতন করেই উঠে এসেছেন টুখেল। ক্লপের প্রথম দল মেইঞ্জের কোচ হয়ে শুরু সেখান থেকে বুরুশিয়া ডর্টমুন্ড। সেখান থেকে গিয়েছিলেন পিএসজি। সময়টা সেখানে ভালো যায়নি তার। ট্রফি জিতেছেন, কিন্তু দিনে দিনে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলেন। এক মাস যেতে না যেতেই ডাক পরলো চেলসি থেকে। নিজেদের লিজেন্ডকে পত্রপাঠে বিদেয় করে তারা শরণাপন্ন হয়েছে টুখেলের।

প্রিমিয়ার লিগের ১৯ রাউন্ডের খেলা শেষ। ৬ হার, ৫ ড্র নিয়ে চেলসি হাবুডুবু খাচ্ছে মিডটেবিলে। সে অবস্থাতে বরখাস্ত হওয়া কোচকে তারা রিপ্লেস করলো আরেক বরখাস্ত হওয়া কোচ দিয়ে। থমাস টুখেল এসেই একটা ফাঁকা বুলি ছাড়লেন, “আমি এই চেলসি দলকে এমন চেলসি দল বানবো যে সকলে খেলতে নামার আগে ভয় পাবে”

সেই কথার ঠিক চার মাস পর টুখেলের চেলসিকে ভয় পায় না এমন দল খুব কমই আছে। ছন্নছাড়া চেলসিকে ছন্দে ফিরিয়েছেন টুখেল। প্রিমিয়ার লিগে হাবুডুবু খাওয়া চেলসি লিগ শেষ করেছে চতুর্থ স্থানে থেকে। দায়িত্ব নেওয়ার পর হাতে গুনে মাত্র চারটি ম্যাচ হেরেছে চেলসি।

ল্যাম্পার্ডের আমলে সবচেয়ে বড় ইস্যু ছিল এই অ্যাটাক আর ডিফেন্সের সমন্বয় খুঁজে পাওয়া নিয়ে। আর সেখানেই সেনানী বানিয়েছেন নিজের বিশ্বস্ত সৈনিক থিয়াগো সিলভাকে। ডানে-বামে ডিফেন্স করার থেকে আক্রমণেই মনোযোগী উইংব্যাকদের করেছেন শক্তির জায়গা।

আগে যে জায়গা দিয়ে একের পর এক গোল হজম করতেন, সেখান থেকেই একের পর এক গোল বের করে নিয়ে গিয়েছেন। নিয়মিত ফরমেশন হতে থাকলো ৩-৫-২, ৩-৪-২-১। ফর্মে ফিরিয়েছেন রুডিগার, ক্রিশ্চেনসেনের মতন খেলোয়াড়কে। গতকাল থিয়াগো সিলভা যখন মাঠ ছেড়ে উঠে গেলেন, সবাই ভেবেছিল এই বুঝি থামলো চেলসির যাত্রা। কিন্তু না। ক্রিশ্চেনসেন সেখান থেকে একাই টেনে নিয়ে গিয়েছেন লড়াইটা।

আক্রমণে ছন্নছাড়া চেলসিকে এক মুহূর্তেই সামলে নিয়েছেন টুখেল। সুযোগ দিয়েছেন, বাদও দিয়েছেন। নিত্যনতুন ফরমেশন, নিত্যনতুন ট্যাক্টিস। সকলকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলিয়েছেন। বুঝেছেন দলের শক্তিমত্তা, দূর্বলতা। এর মাঝেও রেজাল্ট ঠিকই বের করে এনেছেন। টিপিক্যাল জার্মান জেন্টেলম্যান বলতে যা বোঝায়, তাই ছিলেন টুখেল। ফলে মিডিয়া চাইলেও নাম খারাপ করতে পারতো না তার। আর তার ফলটা দিয়েছেন মাঠে।

পর পর দুই মৌসুম ফাইনাল খেলাটা জার্মান কোচদের জন্য নতুন নয়। ইয়ুপ হেইকেন্স খেলেছেন, ইয়ুর্গেন ক্লপ খেলেছেন। থমাস টুখেলও খেললেন। প্রথমটা হেরে দ্বিতীয়টা জিতলেন। শুধু পার্থক্যটা হলো আগের দু’জনে খেলেছিলেন এক দলের জার্সিতে, একই খেলোয়াড়দের নিয়ে মঞ্চ কাঁপিয়েছিলেন।

কিন্তু টুখেলকে করতে হয়েছে দুই দল নিয়ে, দুই জার্সিতে, পুরোপুরি ভিন্ন দুই দল নিয়ে। ফলাফলটাও মাঠে দিয়েছেন তিনি। গার্দিওলা পুরো ইংল্যান্ড জয় করে নত হয়েছেন টুখেলের কাছে। টুখেল তার নির্ভেজাল হাসি দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন বিশ্বকে, ইউরোপ কীভাবে হেসে হেসে জিততে হয়।

চেলসি ডাগ আউট আজীবনই মিউজিক্যাল চেয়ার। ‘হায়ার অ্যান্ড ফায়ার’ নীতিতে বিশ্বাসী রোমান আব্রামোভিচের দল কতদিন টিকতে পারবেন টুখেল সে নিয়ে প্রশ্ন আছে বৈকি। কিন্তু ভঙ্গুর একটা দল নিয়ে হেসে হেসে ইউরোপ জয় করা টুখেল ফুটবলবাসীর কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন আজীবন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...