এক গাদা অর্জন, এক চিমটি আক্ষেপ

একবারও না জেতা ফিফা বিশ্বকাপে জার্মানির হয়ে তিনি ২০০২ আর ২০০৬ মিলিয়ে খেলেছিলেন আটটি ম্যাচ। ২০০২ সালের সাতটি ম্যাচের পাঁচটিতেই ক্লিনশিট রেখেও (সাতটি ম্যাচে হজম করেছিলেন মোট তিনটি গোল) ফাইনালে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে ভাঙা রিং ফিঙ্গারের লিগামেন্ট নিয়ে গোলরক্ষা করে ৬৭ মিনিটে একটি বাজে গোল খাওয়াই ছিল জার্মানীর ০-২ হারের প্রধান কারণ। তারপরে তিনি বলেছিলেন, ‘There is no consolation...it was the only mistake I made in seven games and it was brutally punished.’

১৯৬৯ সালের ১৪ ও ১৫ জুন। পরপর দুদিনে খেলার প্রবাদ জন্ম নিয়েছিলেন তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে। ১৪ জুন স্টেফি গ্রাফ আর ১৫ জুন অলিভার রল্ফ কান। তার জন্মস্থান ছিল পশ্চিম জার্মানীর ২১তম বৃহত্তম শহর কারিসরুহে।

তার বাবা রল্ফ চার বছর খেলেছিলেন কারিসরুহে শহরের ফুটবল টিম কারিসরুহে এস সি-তে , ১৯৬২-১৯৬৫। বাবার আগ্রহই তাকে ১৯৭৫ সালে নিয়ে যায় কারিসরুহে এস সি-তে, যেখানে যোগ দেবার সময় তাঁর বয়স ছিল ছয়। প্রথমে অন্য পজিশনে খেললেও পরে তিনি গোলকিপিংয়ে আসেন।

১২ বছর সেখানের যুব দলে খেলার পরে ১৯৮৭-৮৮ সালে তিনি ওই ক্লাবের প্রফেশনাল স্কোয়াডে অন্তর্ভুক্ত হন। প্রথমে রিজার্ভ গোলরক্ষক, তারপর বুন্দেলশিগায় কারিসরুহে এসসি দলের প্রথম একাদশে প্রথম আসেন ২৭ নভেম্বর ১৯৮৭-তে।

প্রথম ম্যাচেই ০-৪ হার, এফসি কোলনের কাছে। ফলে দলে হয়ে যান অনিয়মিত। ১৮ বছরের কান তাতে না দমে গিয়ে অনুশীলনে ডুবিয়ে দেন নিজেকে এবং ফল পান আরো তিন বছর পরে ১৯৯০ সালে। দলের প্রথম গোলরক্ষক হলেন, দলে অপরিহার্য হলেন পরের চার বছরের জন্য। ১৯৯৩-৯৪ মৌসুমে উয়েফা কাপের শেষ ষোলর প্রথম দফার ম্যাচে ভ্যালেন্সিয়ার বিরুদ্ধে ভ্যালেন্সিয়ার মাঠে ১-৩ গোলে হেরে দ্বিতীয় দফার ম্যাচে ৭-০ গোলে জেতে কারিসরুহে এসসি, নিজেদের মাঠ ওয়াইল্ড পার্কস্টেডিয়নে।

ওই ৭-০ গোলে জেতার ম্যাচটি ইতিহাসে ‘মিরাকেল অ্যাট ওয়াইল্ড পার্কস্টেডিয়ন’ নামে।পরের রাউন্ডে, সেমিফাইনালে এসভি অস্ট্রিয়া স্যাল্জবার্গের কাছে হেরে বিদায় নিয়েছিল কারিসরুহে এস সি।ততদিনে বড় ক্লাবগুলি নজরে এসে গেছেন অলিভার কান। পরের বছর, ১৯৯৪-এ কারিসরুহে এসসি ছেড়ে বায়ার্ন মিউনিখে যাবার আগে ১৯ বছর কাটানো হয়ে গিয়েছিল তার শহরের ক্লাবে, যাদের হয়ে ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৪-এর মধ্যে ১২৮ টি ম্যাচ খেলেছিলেন অলিভার কান।

পরের ১৫ বছর আর দল বদলাননি তিনি অথবা তাকে ছাড়েনি তার ক্লাব। ১৯৯৪ থেকে ২০০৮-এর মধ্যে অলিভার কান বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে ৪২৯টি ম্যাচ খেলেছিলেন। তার গোলরক্ষাকালীন সময়ে বায়ার্ন মিউনিখ জিতেছিল এক বার উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ (২০০০-০১), এক বার উয়েফা কাপ (১৯৯৫-৯৬), আট বার বুন্দেসলিগা (১৯৯৬-৯৭, ১৯৯৮-৯৯, ১৯৯৯-২০০০, ২০০০-০১, ২০০২-০৩, ২০০৪-০৫, ২০০৫-০৬ ও ২০০৭-০৮) আর ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ (২০০১)।

আর একবারও না জেতা ফিফা বিশ্বকাপে জার্মানির হয়ে তিনি ২০০২ আর ২০০৬ মিলিয়ে খেলেছিলেন আটটি ম্যাচ। ২০০২ সালের সাতটি ম্যাচের পাঁচটিতেই ক্লিনশিট রেখেও (সাতটি ম্যাচে হজম করেছিলেন মোট তিনটি গোল) ফাইনালে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে ভাঙা রিং ফিঙ্গারের লিগামেন্ট নিয়ে গোলরক্ষা করে ৬৭ মিনিটে একটি বাজে গোল খাওয়াই ছিল জার্মানীর ০-২ হারের প্রধান কারণ।

তারপরে তিনি বলেছিলেন, ‘There is no consolation…it was the only mistake I made in seven games and it was brutally punished.’ ২০০৬-এর বিশ্বকাপে তিনি প্রথম একাদশে ছিলেন না, কোচ ক্লিন্সম্যানের অনাস্থার কারণে। সেবার তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান নির্ধারণের ম্যাচে পর্তুগালকে ৩-১ গোলে হারানো ম্যাচটিই ছিল তার জার্মানীর হয়ে তার শেষ খেলা। ১৯৯৫-২০০৬, এই ১২ বছরে দেশের হয়ে তিনি খেলেছিলেন মোট ৮৬টি ম্যাচ আর জিতেছিলেন ১৯৯৬ সালে ইউরো কাপ।

গোলরক্ষক হিসেবে একমাত্র ফিফা বিশ্বকাপ গোল্ডেন বল বিজেতার নামও অলিভার কান (২০০২)। সে বছরই ফিফা বিশ্বকাপ লেভ ইয়াসিন পুরস্কারও জিতেছিলেন তিনিই এবং ঢুকে পড়েছিলেন ফিফা বিশ্বকাপ অলস্টার একাদশেও। এছাড়া অগুন্তি ব্যক্তিগত পুরস্কারের মালিক ছিলেন অলিভার কান। ২০০৬য়ের পরে ক্লাবের হয়ে খেলা চালিয়ে যাওয়া তিনি অবসরে যান আরো দুই বছর পরে।

দিনটা ছিল ২৭ মে ২০০৮। ১৩ বছর হয়ে গেল, দেখতে দেখতে। অলিভার কানের ফেয়ারওয়েল ম্যাচ ছিল যুবভারতীতে (৩৯ বছর বয়সে অবসর নিয়েছিলেন তিনি)। সেদিন বায়ার্ন মিউনিখ খেলেছিল মোহনবাগানের বিরুদ্ধে। সেদিন যুবভারতীতে ছিলাম। টিকিট দিয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গলের সদস্য, আমার ব্যাঙ্কের সহকর্মী সুখেন্দমোহন রায়। আজ আবার ধন্যবাদ জানাই সুখেনদাকে এজন্য।

তখন মিন্টো পার্কের উল্টোদিকে রিজিওনাল অফিসে পোস্টেড ছিলাম। সেদিন অফিস কেটে যুবভারতীর তিন নম্বর গেট দিয়ে মাঠে ঢোকার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম এক নম্বর গেটের কাছে।আসলে ১ নম্বর গেটের কাছে চলে গিয়েছিল তিন নম্বর গেটের লাইন।

তিন ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে মাঠে ঢুকেছিলাম কোনরকমে খেলা শুরুর ১০ মিনিট আগে। মাঠে চাপাচাপি ভিড় হয়েছিল সেদিন, একটি আসনও খালি ছিল না যুবভারতীর। বায়ার্ন মিউনিখ ম্যাচটা জিতেছিল ৩-০ গোলে। তবে লড়াই হয়েছিল ওই প্রদর্শনী ম্যাচটায়। ৫৪ মিনিট মাঠে ছিলেন সেদিন অলিভার কান, তার মধ্যেই একটি সম্ভাব্য গোল বাঁচিয়েছিলেন তিনি।

চিরদিন আবেগহীন তার বিদায়মুহূর্তটি ফুটবলের শহরে কিন্তু রচনা করেছিল বেশ কিছু আবেগঘন দৃশ্যকল্পের। তিনি নিজেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে ওই মুহূর্তটাই অনন্ত, যার পরে আর কোনদিন তিনি ‘বলশেভিক’ হবেন না। আমার কাছে আজীবন এক মধুর স্মৃতি হয়ে থাকবে ওই ম্যাচটি স্বচক্ষে দেখা।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...