মধ্যবিত্ত সংসারের টানাপোড়েন

কিঞ্চিৎ অনিশ্চয়তা গ্রাস করলেও বাংলাদেশের মূল পর্বে উত্তরণ নিয়ে সংশয় সেভাবে চেপে বসেনি। আশা করছি, ঠিকই উৎরে যাবে। মূল পর্ব পেরিয়ে আরো এগোবে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেই সামর্থ্য আছে বলেই মনে করি। যদি, কিন্তু অবশেষ থাকে তারপরও। কারণ, সামর্থ্যকে সাফল্যে রুপান্তরের প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে - সীমাবদ্ধতা আইডেন্টিফাই করা। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সুদীর্ঘ ইতিহাসে সেই কাজ হাতে গোণা; এবার যদি করা হয়, তাহলে মধ্যবিত্তের হিসেবি চালচলনে মাহমুদউল্লাহর বাংলাদেশ অসাধারণ কিছু মুহূর্ত সঙ্গী করেই হয়তো ফিরতে পারবে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য শুভকামনা।

মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে আমার মনে হয় মধ্যবিত্ত সংসারের হিসেবি ঘরণীর মতো। টানাপোড়েনের সংসার যিনি ঠিক সামলে নিতে জানেন, তাকে আপনি মাসের সূচনায় যা তুলে দেন তা-ই দিয়ে ঠিক ঠিক ঘর চালিয়ে নেন তিনি। মাহমুদুল্লাহর অধিনায়কত্ব যেন অনেকটা সেরকম। যেটুক রসদ তিনি পাবেন তা-ই দিয়ে সামাল দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। সাকিব বা মাশরাফির মতো উচ্চাকাঙ্খী নন, দূরদর্শিতা আছে কি নেই তা প্রশ্নসাপেক্ষ, তবে সুদূরপ্রসারী নেতৃত্ব নিয়ে ভাবেন না।

ক্যারিয়ার সায়াহ্নে অধিনায়কত্ব পেয়েছেন বলেই এই ব্যাপার ঘটেছে, নাকি আদতেই তিনি এমন, তা ব্যখ্যা করা মুশকিল। কিন্তু তাকে দিয়ে একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকা যায়, হাতে যা আছে তা-ই নিয়ে শত প্রতিকূলতা মুকাবিলা করার সাহস তিনি রাখেন। পরিস্থিতি যত কঠিন হয়, তার মস্তিষ্ক ততই সচল হয় যেন। বাংলাদেশ ক্রিকেটের এবারের বিশ্ব টি টুয়েন্টির অভিযানে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ব্যাপার খুব সম্ভব মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের অধিনায়কত্ব।

বাংলাদেশের চৌরাস্তার জ্যামগুলোতে অনেক সময় ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতি চোখে পড়ে। চারদিক থেকে গাড়ি সবার আগে পৌঁছতে গিয়ে এমন জট পাকিয়ে ফেলে যে, পাটকাঠির মতো শুকনা মানুষেরও পারাপারের উপায় থাকে না। তখনো কিছু ড্রাইভার দেখা যায়, যারা এরমধ্যেও চিপা চাপা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়। হরহামেশা এসব জ্যাম চোখে পড়ে আমাদের, ট্রাফিক ছাড়া, কোনো প্ল্যান প্রোগ্রাম ছাড়াই আবার গাড়িগুলো জ্যাম মুক্ত হয়। বাংলাদেশ ক্রিকেটও চলছে এই জ্যামগুলোর মতো প্ল্যান প্রোগ্রাম ছাড়া।

কেউ গালাগালি করে, কেউ বসে থাকে থম মেরে – এই করতে করতে জ্যাম মুক্ত হওয়ার মতো আমরা আশা করি, টুর্নামেন্টগুলোতে বাংলাদেশও ঠিক চিপা চাপা বের করে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে পৌঁছে যাবে সবার আগে। ক্রিকেট নিয়ন্ত্রকদের ধারণা, পরিকল্পনা — কেবল স্বাস্থ্য আপাদের সুখী পরিবার কর্মসূচীতে থাকলে হবে, ক্রিকেটে এনে জটিলতা বাড়ানো নিষ্প্রয়োজন।

তবুও ছাগলের মতো জাবর কাটা অভ্যাস আমাদের, তাই দু’কথা হয়ে যায় আর কি!

যেকোনো দলের সাফল্য-ব্যর্থতা অনেকটা নির্ভর করে অধিনায়কের উপর। যে দলে দারুণ ফর্মের মুস্তাফিজ আছেন, সেই দলের জন্য ব্যাপারটা আরো গুরুত্বপূর্ণ। নেতৃত্বের ব্যর্থতা না হলে আইপিএলে মুস্তাফিজের দল হয়তো আরো ভালো অবস্থানে যেতে পারতো। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তৃতীয় ও চতুর্থ টি টুয়েন্টিতে মুস্তাফিজকে ব্যবহারে দারুণ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ।

ফলে প্রায় হাত ফস্কে বেরিয়ে যাওয়া ম্যাচ পকেটস্থ হয়। চতুর্থ ম্যাচও সাকিব অমন খরুচে না হলে পক্ষে আসত হয়তো বা। ম্যানেজমেন্ট কী ভাবেন, কীভাবে ভাবেন, জানি না। সাকিবের মতো ক্রিকেটার, যিনি ক্রিকেটটা খেলেন মস্তিষ্ক দিয়েই। টানা ম্যাচ, লো স্কোরিং টেনশন পেরিয়ে, সাকিব তবু স্বাভাবিক থাকবেন তা অসম্ভব। একদিক থেকে বিবেচনা করলে, ম্যাচটা মূলত সিলেকশনের কারণে হেরেছিল, সাকিবের বাজে বোলিংয়ে নয়।

সাকিবকে টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান না ভেবে টি টুয়েন্টিতে বোলিং অলরাউন্ডার ভাবার সাহস টীম ম্যানেজমেন্টের হবে না বোধয়। সেই টি-টোয়েন্টির সূচনা থেকে বাংলাদেশ পাওয়ার ব্যাটিং নিয়ে ভুগছে। এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠার কোনো চেষ্টা অবশ্য দেখা যায়নি। ছক্কা নাইম বা ফিনিশার মাহমুদউল্লাহ পর্যন্তই গেছে ম্যানেজমেন্ট। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে এখন লিটন, আফিফ ও শামীমের মতো তিনটি রত্ন আছে।

যাদেরকে দিয়ে পাওয়ার ব্যাটিংয়ের ঘাটতি কিছুটা মেটানো সম্ভব বলে মনে করি। মাহমুদউল্লাহ অন ফিল্ড ক্যাপ্টেন্সিতে আমার অত্যন্ত ফেভারিট। অফ ফিল্ড নেতৃত্বে স্মার্টনেস কতটা দেখাতে পারবেন কে জানে! তিনি ও সাকিব কিছুটা নীচে নেমে আফিফ-শামীমকে সুযোগ দিতে পারেন।

একমাত্র মুশফিকই হয়তো ওপরের দিকে খেলার সামর্থ্য রাখেন। টুর্নামেন্ট গড়ালে ম্যাচ-বাই-ম্যাচ সাকিব-মুশফিকের ফর্ম বিবেচনায় তাদের কাউকে একাদশের বাইরে রাখার সাহসও হবে না হয়তো। সৌম্য যদি টাচে ফেরেন, তাহলে লিটন-সৌম্য ওপেনিং দারুণ হয়। অনেকে নাইমের সমালোচনা করেন, অথচ দিল্লীর কোটলায় ওর ৪৮ বলে ৮১ বাংলাদেশ ক্রিকেটের টি টুয়েন্টি ইতিহাসের অন্যতম ক্ল্যাসিক। তিনি সামর্থ্যের সেরাটা দিতে পারবেন আশা করছি।

সাইফ উদ্দিনকে পাওয়ার হিটার হিসেবে খেলিয়ে ওর প্রতি কি অবিচার করা হচ্ছে না? ব্যাটিং অর্ডারে আরো উপরের দিকে খেলার সামর্থ্য আছে তার, যদিও এই মুহূর্তে তা সম্ভব নয়। তবে সাইফ উদ্দিন ও মাহেদি হাসান ব্যাটিং ডেপথ বাড়িয়েছেন নিশ্চিত। মুস্তাফিজ, শরীফুল, তাসকিনদের নিয়ে বোলিং আক্রমণটাই মনে হয় ব্যাটিংয়ের চেয়েও বড় ভরসার জায়গা। সংযুক্ত আরব আমিরাতের উইকেটে বাংলাদেশের এই বোলিং চমৎকার মানিয়ে যাওয়ার কথা। ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে যদি আরেকটু সাহসী হওয়া যায়, আফিফ, শামীম, সোহানদের মতো তরুণদের আরো কিছু বল বেশি খেলার সুযোগ দেয়া যায়, তাহলে কিন্তু বেশ ভালো সম্ভাবনা আছে বাংলাদেশের।

একটা ব্যাপার খুব চোখে লাগে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সমালোচনা দেখে একে-তাকে নেয়া ও বাদ দেয়া। টীম ম্যানেজমেন্টের কাজটা কী তাহলে? একজন ক্রিকেটারকে কী বার্তা দেয়া হচ্ছে? উইকেটরক্ষক নিয়ে শোরগোল হলো তাই সোহান দলে ঢুকেছেন। টি-টোয়েন্টিতে লিটন-মুশফিক থাকার পরও, ৬-৭-৮-৯ নাম্বারে সোহানকে খেলিয়ে কী লাভ আমি জানি না।

আর যদি নেয়া হয়, তাহলে ওকে দিয়ে ভিন্ন কিছু চেষ্টা হোক। ওপেনিং বা টপ অর্ডারে ক’টা সুযোগ দেয়া যেত। তা না করে মানুষের কথা ধরে উইকেট কিপার হিসেবেই ওকে খেলানো হচ্ছে। কোন ফরম্যাটে কার কী রোল – এসব একদম সাধারণ পর্যায়ের সিলেকশন, তিন সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচক কমিটি খুব সম্ভব অনলাইনে মানুষ কী ভাবছে তা-ই দেখছেন আজকাল!

বাংলাদেশ ক্রিকেট বিশ্বক্রিকেটের সুবিশাল পাঠশালার অমনোযোগী ছাত্র। ধারাবাহিক ব্যর্থতা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা সত্ত্বেও এই যে আমাদের আশার বুদ বুদ কখনো শেষ হয় না, চিপা চাপা দিয়ে উৎরে যাক এই কামনা রাখি, বাংলাদেশ ক্রিকেটের না-এগোনোর এটাও কি একটা কারণ?

ঠিক জানি না। কারণটা হয়তো আরো গভীরে, শেকড়ে। দেশের ক্রিকেটের কর্ণধার যখন নিজের বিকল্প খুঁজে পান না তখন ঠোঁট বাকিয়ে হাল ছেড়ে দেয়া ছাড়া উপায় থাকে না আসলে। নিয়তির ভরসায় চলুক। ইন্ডিভিজ্যুয়াল ব্রিলিয়ান্স বা ক্রিকেটারদের সর্বস্ব নিংড়ে দেয়া শ্রম-নিবেদনের বদলে কিছু আনন্দ জুটুক আমাদের, এটুকুই চাওয়া। আর না পেলেও সমস্যা নেই। বাংলাদেশ তো শিখছে, শিখবে আরো। শেখার চেষ্টাটাই হচ্ছে মূল, পাশ-ফেইল, জয়-পরাজয় বা সাফল্য-ব্যর্থতা ওসব দুর্মুখদের বানানো।

বিশ্ব টি টুয়েন্টিতে মূলপর্বের পূর্বে এই বাছাইপর্ব প্রক্রিয়া বিরক্তিকর টুর্নামেন্ট ফরম্যাট। অনায়াসে ১৬ থেকে ২০ দলের মূলপর্বের আয়োজন সম্ভব। জিম্বাবুয়ের কথা বাদ দিই, নেপাল দলটা কত দ্রুত উন্নতি করছে! এই শতকের শুরু ও গত শতকের শেষের দিকে ক্রিকেটের বিস্তৃতি নিয়ে চমৎকার উদ্যোগ ছিল। বছর বছর বিশ্বকাপে দল বাড়ছিল। কিন্তু এলিটজম-এর বিষফোঁড়া সব গুবলেট পাকিয়ে দিয়েছে আবার। শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ না হয় বাদ দিন, ওমান, স্কটল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ডের মতো দল থেকে কোনো কোনোটা মূল টুর্নামেন্টে থাকবে না – কী দুঃখজনক ব্যাপার!

কিঞ্চিৎ অনিশ্চয়তা গ্রাস করলেও বাংলাদেশের মূল পর্বে উত্তরণ নিয়ে সংশয় সেভাবে চেপে বসেনি। আশা করছি, ঠিকই উৎরে যাবে। মূল পর্ব পেরিয়ে আরো এগোবে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেই সামর্থ্য আছে বলেই মনে করি। যদি, কিন্তু অবশেষ থাকে তারপরও। কারণ, সামর্থ্যকে সাফল্যে রুপান্তরের প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে – সীমাবদ্ধতা আইডেন্টিফাই করা। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সুদীর্ঘ ইতিহাসে সেই কাজ হাতে গোণা; এবার যদি করা হয়, তাহলে মধ্যবিত্তের হিসেবি চালচলনে মাহমুদউল্লাহর বাংলাদেশ অসাধারণ কিছু মুহূর্ত সঙ্গী করেই হয়তো ফিরতে পারবে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য শুভকামনা।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...