স্টেফানো সাগা: ইতিহাস কাঁপানো দলবদল

ডি স্টেফানো আর্জেন্টাইন ক্লাব রিভার প্লেটের হয়ে খেলতেন, রিভার প্লেটের হয় মাঠ মাতিয়ে পাড়ি জমান কলম্বিয়ান ক্লাব মিলিওনারিওসে। সেখানে একের পর এক অনবদ্য পারফরম্যান্স দিয়ে ইউরোপের সব বড় ক্লাবের নজরে চলে আসেন। একবার স্পেনে খেলতে এসেছিলেন, তারপর থেকে বার্সেলোনা এবং রিয়াল মাদ্রিদ ছিলো তার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী। কিন্তু, সমস্যা হলো কলম্বিয়ান লিগ তখন ফিফা নিবন্ধিত ছিলো না , তাই সেই লিগের কোনো খেলোয়াড়কে যদি কোনো ফিফা নিবন্ধিত লিগের দল কিনতে চায় তাহলে ফিফা নিবন্ধিত থার্ড পার্টি অথবা খেলোয়াড়ের আগের দলের সাথে বসে তিনপক্ষ মিলে ডিল করতে হবে।

ফুটবলের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়িদের নাম নিতে চাইলে, সবার উপরের সারিতেই থাকবেন আলফ্রেডো ডি স্টেফানো। রিয়াল মাদ্রিদকে সবচেয়ে বড় ইউরোপিয়ান ক্লাবে পরিণত করার মূলনায়ক হলেন তিনি। ডি স্টেফানো মাদ্রিদের হয়ে না খেললে, আজ হয়তো মাদ্রিদের ইতিহাস অন্যরকমই হতো।

মজার ব্যাপার  হল, ডি স্টেফানোর আসলে রিয়াল মাদ্রিদের প্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার হয়ে খেলার কথা ছিলো, এমনকি বার্সেলোনার হয়ে প্রাক মৌসুমেও অংশগ্রহণ নিয়েছিলেন। তাহলে শেষপর্যন্ত কি এমন হলো, যার কারণে বার্সেলোনা হারিয়েছিলো এই গ্রেট কে? সেই নাটকীয় বদবদলের স্মৃতিচারণাই করবো আজ।

প্রথমে ডি স্টেফানোর গ্রেটনেসের ব্যাপারে না বললেই নয়। ফুটবলের ইতিহাসে মাত্র একজন ব্যক্তিকে সুপার ব্যালন ডি অর সম্মানে ভূষিত করা হয়, আর তিনি হলেন ডি স্টেফানো। তিনি মাদ্রিদে আসার আগে শেষ ২৪ বছরে মাদ্রিদ মাত্র দু’বার লিগ জিতে, অত:পর ডি স্টেফানো মাদ্রিদে এসে ১১ বছরে মাদ্রিদ কে আট বার লিগ জেতান। ইতিহাসের একমাত্র দল হিসেবে টানা পাঁচটি চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জয় করে মাদ্রিদ, স্টেফানোর সৌজন্যে। তার মাধ্যমেই ইউরোপিয়ান জায়ান্ট হিসেবে মাদ্রিদের উথান হয়, রিয়াল মাদ্রিদকে নিয়ে যান সর্বোচ্চ উচ্চতায়।

কিন্তু, এসব কিছু তাঁর করার কথা ছিলো বার্সেলোনার জার্সি গায়ে দিয়ে বার্সেলোনার জন্য, যদি না বার্সেলোনা বোর্ড সেই  ভুলটা করতো।

ডি স্টেফানো আর্জেন্টাইন ক্লাব রিভার প্লেটের হয়ে খেলতেন, রিভার প্লেটের হয় মাঠ মাতিয়ে পাড়ি জমান কলম্বিয়ান ক্লাব মিলিওনারিওসে। সেখানে একের পর এক অনবদ্য পারফরম্যান্স দিয়ে ইউরোপের সব বড় ক্লাবের নজরে চলে আসেন। একবার স্পেনে খেলতে এসেছিলেন, তারপর থেকে বার্সেলোনা এবং রিয়াল মাদ্রিদ ছিলো তার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী।

কিন্তু, সমস্যা হলো কলম্বিয়ান লিগ তখন ফিফা নিবন্ধিত ছিলো না , তাই সেই লিগের কোনো খেলোয়াড়কে যদি কোনো ফিফা নিবন্ধিত লিগের দল কিনতে চায় তাহলে ফিফা নিবন্ধিত থার্ড পার্টি অথবা খেলোয়াড়ের আগের দলের সাথে বসে তিনপক্ষ মিলে ডিল করতে হবে। অর্থাৎ ট্রান্সফারের কাগজে ফিফা নিবন্ধিত দল দেখাতে হবে।

তখন, ট্রান্সফারের জন্য তার পূর্বের ক্লাব রিভারপ্লেটকে তার অর্ধেক মালিকানা দিয়ে ট্রান্সফারের দায়িত্ব দেওয়া হলো। তার জন্য সর্বপ্রথম অফার টি এলো বার্সেলোনার কাছ থেকে, বার্সেলোনার অফারে রিভার প্লেট রাজি হয়ে ডিল ক্লোজ করে ফেললো। কিন্তু, ডিলের কাগজে একটা টার্ম জুড়ে দেয় যা বার্সেলোনার বোর্ড ততটা গুরুত্ব দেয় নি, সেটি হলো তার বর্তমান ক্লাব মিলিওনারিয়েসের যদি পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট না হয় তবে তারা ডিল ক্যান্সেল করে দিতে পারবে।

অর্থাৎ, অফিসিয়াল ক্লাব রিভারপ্লেটের সাথে ডিল ক্লোজ হয়ে গেলেও তার ‘আন অফিসিয়াল’ বর্তমান ক্লাবের সাথে আর্থিক ব্যাপারে বার্সার কথা পাকাপাকি হওয়া তখনো বাকি। তখনকার দিনে ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলো থার্ড পার্টি দিয়ে এরকম ডিল করে ছোট দলগুলোকে ঠকিয়ে ফুটবলার নিয়ে যেতো, যার কারনে মিলিওনারিওস বুদ্ধি করে রিভারপ্লেটকে বলে ডিলে এই টার্ম টা জুড়ে দিয়েছিলো। পরবর্তীতে এই টার্মটাই বার্সার কাল হয়ে দাড়ায়।

কিন্তু বার্সা সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে মিলিওনারিওসকে ছোট ক্লাব মনে করে এত অল্প টাকা প্রস্তাব করে বসে যা ছিলো সেই ক্লাব এবং ডি স্টেফানোর জন্য রীতিমতো অসম্মানজনক। তার ওপর তারা বিড করতে নিয়ে গিয়েছিলো মিলিওনারিওসের লোকাল রাইভাল ক্লাবের হবু ডিরেক্টর জুয়ান বুস্কেটকে, যার কারশে মিলিওনারিওস আরো বেশি অপমানিত বোধ করে। বার্সার এই অপমানের জন্য মিলিওনারিওস এমন ভাবে বেকে বসে যে একপর্যায়ে তারা ডি স্টেফানো কে বার্সার কাছে বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানায়।

তখন, প্রেক্ষাপটে আসে রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সার এই ভুলের সুযোগ নেয় তাঁরা। মিলিওনারিওসকে উপযুক্ত দাম দিয়ে তাদেরকে রাজি করিয়ে নেন সাবেক রিয়াল প্রেসিডেন্ট সান্তিয়াগো বার্নাব্যু। এবার অফিসিয়ালি ডিল কমপ্লিট করতে যান রিভার প্লেটের কাছে। কিন্তু রিভার প্লেট বলে, আমরা বার্সেলোনার সাথে ডিল করে ফেলছি, আমাদের শেয়ার বার্সেলোনার হাতে চলে গেছে।

এবার ঘটনায় আসলো নতুন মোড়। বার্সেলোনা রিভারপ্লেটের অংশের শেয়ার কিনে নিলেও ট্রান্সফার পেপারের ওই একটা টার্ম পুরো ট্রান্সফারকে আটকে দেয়। মিলিওনারিওস কোনোভাবেই স্টেফানোকে বার্সায় যেতে দিবে না। আর বার্সাও শেয়ার ফেরত দিবে না কারণ এতে স্টেফানো চলে যাবেন রিয়াল মাদ্রিদের হাতে।

বার্সা তখন চাইলে রিভার প্লেটকে শেয়ার ফেরত দিয়ে টাকা পুনরুদ্ধার করতে পারতো। কিন্তু, প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের কাছে এভাবে হেরে যাওয়া তাদের কাছে মঞ্জুর নয় । এতো নাটকের মধ্যে ডি স্টেফানো বার্সার হয়ে প্রি সিজনে যোগ দিলেন, কিন্তু মিলিওনারিওস এর অনুমতি ছাড়া অফিসিয়াল কোনো ম্যাচ খেলতে পারবেন না।

শেষ পর্যন্ত কোনো সুরাহা না পাওয়ায় ফিফা পর্যন্ত বিষয়টা গেলো। স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন এবং ফিফা এই তিনপক্ষকে নিয়ে বসলো। বার্সেলোনা-রিভার প্লেটের ট্রান্সফার পেপারের এই টার্মের কারনে কোনো নির্দিষ্ট সমাধানে আসা গেলো না কারন কোনো পক্ষই কম্প্রোমাইজ করতে রাজি নয়।

বার্সা শেয়ার ফেরত দিবে না আর মিলিওনারিওস ও বার্সার হয়ে ডি স্টেফানো কে খেলতে দিবে না। তখন কোনো উপায় না পেয়ে ফিফা বাধ্য হয়ে রায় দিলো ডি স্টেফানো বার্সেলোনা এবং রিয়াল মাদ্রিদ উভয় দলের হয়ে ফুটবল খেলবেন, এক সিজনে বার্সায় তো আরেক সিজন রিয়ালে এরকম ভাবে খেলে যাবেন।

কিন্তু, বার্সেলোনা এই রায় মেনে নিতে পারে নি। তারা রিয়ালের হয়ে খেলো কোনো খেলোয়াড়কে তাঁদের দলে নিবে না। তাঁরা মনে করে তাদের সাথে অন্যায় হয়েছে। কেউ কেউ বোর্ড আর প্রেসিডেন্টকে দোষ দেয়। এই ব্যার্থতার কারণে রাগে দুঃখে অপমানিত বোধ করে বার্সার প্রেসিডেন্ট মার্টি কারেটো পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। অবশেষে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেয় ডি স্টেফানোর শেয়ার মাদ্রিদের কাছে বিক্রি করার যাতে করে শেয়ারের ৪.৫ মিলিয়ন পূররুদ্ধার করা যায়। এভাবেই তাদের হারাতে হয় শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফুটবলারকে। আর এই এক ট্রান্সফারে রিয়ালের মাদ্রিদের ইতিহাস বদলে যায়।

 

বোর্ডের অপেশাদার আচরণ আর নিছক বোকামির কারণে সেদিন বর্সেলোনাকে অনেক বড় কিছু হারাতে হয়, যার আফসোস হয়তো কিউলদের মনে আজো আছে। সেদিন যদি বার্সা মিলিওনারিওসকে ছোট না করে পর্যাপ্ত টাকাটা দিয়ে দিতো তাহলে ইতিহাস টা আজ অন্যরকম হতে পারতো।

ডি স্টেফানো তার প্রথম এল ক্লাসিকো তে বার্সেলোনার বিপক্ষে ৪ গোল করেন। এরই মধ্য দিয়ে স্পেনের মাটিতে উথান হয় এক কিংবদন্তির, যিনি পুরো ইউরোপজুড়ে রাজত্ব করেছেন রিয়ালের সাদা জার্সিতে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...