Social Media

Light
Dark

কাতালান সভ্যতার বর্ণীল এক চরিত্র

ফুটবলার পরিচয় ছাপিয়ে তিনি কখনো হয়ে উঠেছেন কাতালান মুক্তিকামী মানুষের প্রতিবাদের কন্ঠস্বর। কেউ তাঁকে ডাকে প্রেসিডেন্ট নামে। ক্লাব এবং জাতীয় পর্যায়ের সম্ভাব্য সকল ট্রফিই জিতেছেন।

কার্লোস পুয়োলকে সাথে নিয়ে গড়েছিলেন দুর্ভেদ্য এক রক্ষণ জুটি। দর্শকরদের ভালোবাসা যেমন পেয়েছেন, নিন্দাও কম কুড়াননি। বিতর্ক তাঁর জীবনে এগিয়েছে সমান্তরাল গতিতে। তিনি জেরার্ড পিকে, বার্সেলোনার রক্ষণের অতন্দ্র প্রহরী। 

কাতালুনিয়ায় জন্ম নেয়া পিকের ক্যারিয়ারের শুরুটা নিজের শহরের ক্লাব বার্সেলোনা দিয়েই। মাত্র দশ বছর বয়সেই বার্সার ছোটদের ক্লাব আলেভিন বি’র হয়ে ফুটবল শুরু। তখন কি আর জানতেন তাঁর ক্যারিয়ারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাবে ক্লাবটি!

সেই ছোটবেলা থেকেই বহু ক্লাব প্রস্তাব পাঠিয়েছে পিকেকে দলে টানার। কিন্তু শৈশবে ভালোবাসার ক্লাব ছাড়ার কথা স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি। শুরুতে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে খেললেও ক্রমেই বনে যান পুরোদস্তুর সেন্টারব্যাক। 

তবে অনেকেই জানেন না, পিকের পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু কিন্তু বার্সেলোনা দিয়ে নয়। বরং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড দিয়ে, ২০০৫ সালে এফএ কাপের ম্যাচে প্রথমবারের মতো মাঠে নামেন। রেড ডেভিলদের হয়েই লিগ জেতার পাশাপাশি জেতেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপাও।

এরপর মাঝে এক মৌসুম রিয়াল জারাগোজায় লোনে কাটালেও পিকের মন পড়ে ছিল বার্সায়। অন্যদিকে কাতালান ক্লাবটিও চাইছিলো ঘরের ছেলেকে ফিরিয়ে আনার। তবে তাঁর দলবদল নিয়েও হয়েছে নাটক, স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন তো ঘোষণাই দিয়েছিলেন পিকে বিক্রির জন্য নয়। 

কিন্তু সব জলনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২০০৯ সালে ৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বার্সায় ফিরে আসেন পিকে। এরপরের এক যুগ কাতালান শিবিরেই কাটিয়েছেন। শুরুতে কার্লোস পুয়েল, হাভিয়ের মাসচেরানো সাথে জুটি বাঁধার পর, ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে দলের রক্ষণ সামলেছেন স্যামুয়েল উমতিতি, রোনাল্ড আরাউহোদের মতো তরুণদের সাথে। 

এক যুগের বেশি সময়ে ক্লাব ফুটবলের সম্ভাব্য সকল ট্রফিই জিতেছেন বার্সার হয়ে। মেসি, ইনিয়েস্তা, জাভিরা নির্ভারচিত্তে প্রতিপক্ষের রক্ষণে আক্রমণ শানিয়েছেন রক্ষণে পিকের ভরসায়।

সোনালি যুগের সেই বার্সার হয়ে ট্রেবল জেতার পর ২০১৫ সালে এমএসএন ত্রয়ীর সাথ মিলে জেতেন ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ট্রেবল। আটবার লা লিগার শিরোপা জেতার পাশাপাশি কোপা দেল রে জিতেছেন সাতবার। 

যখন যে টুর্নামেন্টেই সাফল্য উপচে পড়েছে পিকের পায়ে। জাতীয় দলেও ধরে রেখেছেন সে ধারা। ২০০৬ সালে অনুর্ধব-১৯ ইউরো জিতে শুরু করেছিলেন সাফল্যের যাত্রা। সেবারে ফাইনালে রক্ষণ সামলানোর পাশাপাশি জয়সূচক গোলের অ্যাসিস্টও ছিল তাঁর।

বার্সার হয়ে দারুণ খেলার সুবাদে ২০০৯ সালেই জাতীয় দলে ডাক পেয়ে যান তিনি। এরপর ইউরো জেতার পাশাপাশি লা রোজাদের এনে দিয়েছেন তাঁদের ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ। বিশ্বকাপের সে আসরে স্পেনের হয়ে প্রতিটি ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন। রক্ষণে তাঁর এবং কার্লোস পুয়োলের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স সুবাদেই কিনা ইতিহাসের সর্বনিম্ন সংখ্যক গোল করেও শিরোপা জিতেছিল তাঁরা। 

কেবল রক্ষণ সামলানো নয়, বরং প্রয়োজনের মূহুর্তে হেডে গোল করতে পিকের জুড়ি মেলা ভার। আদতে সেন্টারব্যাক হলেও বল পায়ে দক্ষ হওয়ায় বিভিন্ন পজিশনে খেলতে জানতেন পিকে। মাঝে তো কয়েকদিন ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের রেখে যাওয়া বিখ্যাত লিবেরো পজিশনে খেলেছেন তিনি।

অনেকে মজা করে ডাকতেন ‘পিকেনবাওয়ার’। তবে ক্যারিয়ারের শেষদিকে গতি কমে যাওয়ায় উইংগারদের বিপক্ষে বেস ভুগতে হয়েছে তাঁকে। সহজ সব ভুল করে সমর্থকদের হাস্যরসের পাত্র হয়েছে বারবার। তবে সেরা ফর্মের পিকে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার এ নিয়ে দ্বিমত করবেন না কেউই। 

ক্যারিয়ারের শুরুতে স্বর্ণালি সেই অপ্রতিরোধ্য বার্সার হয়ে খেলেছেন। এরপর সে সময় ফুরিয়ে দেখেছেন অর্থনৈতিক মন্দায় জর্জরিত ক্লাবকে। ক্লাবের স্বার্থে বেতন কমিয়েছেন বারবার, প্রয়োজনে বিনা পারিশ্রমিকে খেলার ব্যাপারেও সম্মতি ছিল তাঁর। কিন্তু বুঝতে পারছিলেন শরীরটা আর সায় দিচ্ছে না, তরুণদের সাথে আগের মতো তাল মেলাতে পারছেন। সেই কারণেই কিনা এবারের মৌসুমের মাঝপথে বিদায় জানান ফুটবলকে। 

কেবল মাঠের ফুটবল নয়, মাঠের বাইরেও পিকে এক বর্ণালি চরিত্র। ২০১০ বিশ্বকাপের সময় কলম্বিয়ান গায়িকা শাকিরার সাথে সম্পর্কে জড়ান। গোটা বিশ্ববাসী অবাক হয়ে গিয়েছিল তাঁদের প্রণয়ের সংবাদে। এরপরের সময়টা অবশ্য সুখের, টানা একযুগ পৃথিবীর মানুষের কাছে অনুসরণীয় দম্পতি হিসেবেই স্থান করে নিয়েছিলেন তাঁরা।

কিন্তু ২০২২ সালে সবাইকে হতভম্ভ করে দিয়ে বিচ্ছেদের ঘোষণা দেন তাঁরা। এরপর জানা যায় আসল ঘটনা, ক্লারা চিয়া মার্তির নামের এক তরুণীর সাথে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন পিকে। নিন্দার ঝড় উঠে গোটা বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠে, খলনায়কে পরিণত হন এই তারকা। এছাড়া ট্যাক্স ফাঁকির ঘটনায় একবার জরিমানাও দিতে হয়েছিল এত তারকাকে। 

ফুটবল ইতিহাসে পিকে এক বর্ণালি চরিত্র। সমর্থকদের ভালোবাসা পাবার পাশাপাশি বারবার জড়িয়েছেন বিতর্কিত সব কাণ্ডে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বার্সা রক্ষণের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবেই। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link