ক্রিকেটের দুর্লভতম প্রজাতি

১৯৭০ সালের আগে মাত্র রিচি বেনোর ঝুলিতে ২০০০ রান আর ২০০ উইকেটের ‘ডাবল ডাবল’ ছিল। ১৯৯০এর শেষে দেখা গেল চারজন অলরাউন্ডারের ঝুলিতে ৩০০০ এর ওপর রান আর ৩০০’র ওপর উইকেট। তার মধ্যে একজন সেটাকে নিয়ে গেল ৫০০০-এর ওপর রান আর ৪০০-র ওপর উইকেটে। রানের ক্ষেত্রে এই উন্নতির পরিমাণ ১৩৮%, উইকেটের ক্ষেত্রে ৭৫%। সুতরাং যতই সানি, ভিভ, চ্যাপেল, জাভেদের মতো ব্যাটসম্যান বা লিলি, রবার্টস, হোল্ডিং, মার্শালের মতো বোলাররা থাকুন, এই স্বর্ণযুগে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন অলরাউন্ডাররাই।

১৯৭০-৭১ সাল। এই বছরটাকে ক্রিকেটের স্বর্ণযুগের আরম্ভের বছর হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এরপর প্রায় এক দশক ধরে একের পর এক নক্ষত্র পদার্পণ করবেন ক্রিকেট মাঠে। সেই সঙ্গে পুলকিত করবেন ক্রিকেট প্রেমীদের। একে অপরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তারা চেষ্টা করবেন নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে, আর এই তাদের এই লড়াই জন্ম দেবে নতুন নতুন ক্রিকেটের রূপকথার।

আসুন কয়েকটা স্মরণীয় আত্মপ্রকাশের দিকে নজর দেওয়া যাক।

১৯৭০ সালের শেষদিকে প্রথম টেস্ট খেলেন স্টাইলিশ অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান গ্রেগ চ্যাপেল। এবং শুরুটাই হয় সেঞ্চুরি দিয়ে। ৫০-এর ওপর গড়ে ৭০০০-এর বেশি রান করবেন এই ভদ্রলোক নিজের পনের বছরের টেস্ট ক্যারিয়রে।

মাস দুয়েক পরেই, ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে টেস্ট ক্রিকেটে পা রাখেন আরও এক অল টাইম গ্রেট অস্ট্রেলিয়ান – ডেনিস কিথ লিলি। ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে লিলি আরম্ভ করেন তার ধ্বংসলীলা। এই ধ্বংসলীলা চলবে প্রায় চৌদ্দ বছর, যখন লিলি বুট খুলবেন ততদিনে ক্রিকেট বিশ্ব মোটামুটি একমত যে তিনিই তার প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ ফাস্ট বোলার। ভুল হল, শ্রেষ্ঠ বোলার। টেস্টের সবচেয়ে বেশি উইকেটও তখন তার ঝুলিতে।

তবে চ্যাপেল বা লিলি নন, সেই সময়ের সবচেয়ে চমকপ্রদ ক্যারিয়রের সুচনা করেন এক খর্বকায় ভারতীয়। নাম শুনেছেন নিশ্চয় – সুনীল মনোহর গাভাস্কার। চার টেস্টের সিরিজে মোট ৭৭৪ রান করেন সানি, গড় প্রায় ১৫৫। এতে আছে তিন তিনটে সেঞ্চুরি এবং একটা ডাবল সেঞ্চুরি। আত্মপ্রকাশেই এতটা সাফল্য আর কেউই পান নি ক্রিকেট ইতিহাসে, স্যার ডনও নন। সানি যখন নিজের ব্যাট তুলে রাখবেন তখন টেস্ট ক্রিকেটের প্রায় সব প্রধান রেকর্ডই ওনার কব্জায়। সর্বাধিক রান এবং সর্বাধিক সেঞ্চুরি সহ।

তবে সবার আরম্ভই এতটা বিস্ফোরক হয় না। অনেক ক্রিকেটার আছেন যাদের ক্যারিয়রের আরম্ভ দেখে কেউই আঁচ করতে পারেন নি যে তারা আগামী দিনে ক্রিকেট বিশ্ব কাঁপাতে চলেছেন। এদেরই মধ্যে একজন নিজের প্রথম টেস্ট খেলেন ১৯৭১ সালের জুন মাসে, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে।

একমাত্র ইনিংসে ব্যাট হাতে তার সংগ্রহ ৫ রান, বল হাতে দুই ইনিংস মিলিয়ে উইকেটের সংখ্যা শুন্য। স্বাভাবিক ভাবেই পাকিস্তানের দল থেকে বাদ যান এই ১৮ বছরের তরুণ। জাতীয় দলে খেলার পরবর্তী সুযোগ পান তিন বছর বাদে। এনারও নাম না শোনার কথা নয় পাঠকদের – ইমরান খান নিয়াজি।

তবে ইমরানের প্রসঙ্গে আমরা একটু পরেই ফিরে আসব। তার আগে দেখে রাখি আর কাদের পদার্পণ ঘটেছিল এই দশকে। ফাস্ট বোলারদের মধ্যে বব উইলিস, অ্যান্ডি রবার্টস, মাইকেল হোল্ডিং, জোয়েল গার্নার, ম্যালকম মার্শাল। ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ভিভ রিচার্ডস ও জাভেদ মিয়াদাদ।

এবং ইমরানের আরও তিন সঙ্গী।

টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে দুর্লভ প্রজাতি হল অলরাউন্ডার। ১৯৭০এর আগে অব্দি টেস্টে ২০০০এর ওপর রান আর ১৫০র ওপর উইকেট দখল করার গৌরব অর্জন করেছিলেন মোট চারজন ক্রিকেটার – অস্ট্রেলিয়ার কিথ মিলার, ভারতের ভিনু মানকড়, অস্ট্রেলিয়ার রিচি বেনো এবং অবশ্যই, স্যার গ্যারি সোবার্স। এদের মধ্যে ২০০র ওপর উইকেট ছিল মাত্র দুইজনের – বেনো আর গ্যারি। এবং এই অলরাউন্ডারদের মধ্যে দুর্লভতম হচ্ছে ফাস্ট বোলিং অলরাউণ্ডার।

কারণটা আঁচ করা এমন কিছু শক্ত নয়। এমনিতেই ফাস্ট বোলিং ক্রিকেটের সবচেয়ে পরিশ্রমের কাজ। ফাস্ট বোলারদের চোট – আঘাত লাগার সম্ভাবনাও অন্যদের থেকে অনেকটাই বেশি। মূলত এই দুটো কারনেই ব্যাটসম্যান বা স্পিনারদের তুলনায় তাদের ক্যারিয়রও অনেক ছোট হয়। একজন স্ট্রাইক বোলারকে এরপর যদি ব্যাটিংয়েও মন দিতে বলা হয় তাহলে সেটা বাড়াবাড়ি হিসেবে মনে হওয়া স্বাভাবিক। সেই জন্যেই, ওপরের চারটে নামের মধ্যে মাত্র একটাই ফাস্ট বোলার – কিথ মিলার।

এরপরের দুই দশকে ছবিটা আমুল পাল্টে যাবে। এতটাই যে এরপর মানুষ প্রায় সব টেস্ট দলেই একটা করে ফাস্ট বোলিং অলরাউন্ডার খোঁজার চেষ্টা করবে। আর এরই ফলে এমন কিছু ক্রিকেটারের ওপর এই তকমা সেঁটে দেওয়া হবে যার ভারে বেচারিরা হাঁসফাঁস করে যাও বা অর্জন করতে পারত, সেটুকুও পারবে না।

এই পরিবর্তন যে ঠিক কতটা সেটা বোঝার চেষ্টা করা যাক। ১৯৭০ সাল অবধি টেস্ট ক্রিকেটে সর্বাধিক মোট রানের রেকর্ড ছিল ওয়ালি হ্যামন্ডের নামে – ৭২৪৯। ১৯৭০এর দশকে গ্যারি সেই রেকর্ডকে টেনে নিয়ে গেলেন ৮০৩২ পর্যন্ত। ১৯৮৭ সালে সানি অবসর নিলেন ১০১২২ রান করে।

অর্থাৎ ১৯৭০-৯০ এই দুই দশকে মোট রানের রেকর্ড বাড়ল ৭২৪৯ থেকে ১০১২২ – প্রায় ৪০ শতাংশ। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি উইকেট দখলের রেকর্ড এগোল ফ্রেডি ট্রুম্যানের ৩০৭ থেকে স্যার রিচার্ড হ্যাডলির ৪৩১ অব্দি – এখানেও উন্নতির শতাংশ ৪০এর সামান্য বেশি।

অলরাউন্ডারদের ক্ষেত্রে এই উন্নতি অনেক অনেক বেশি। ১৯৭০ সালের আগে মাত্র রিচি বেনোর ঝুলিতে ২০০০ রান আর ২০০ উইকেটের ‘ডাবল ডাবল’ ছিল। ১৯৯০এর শেষে দেখা গেল চারজন অলরাউন্ডারের ঝুলিতে ৩০০০ এর ওপর রান আর ৩০০’র ওপর উইকেট। তার মধ্যে একজন সেটাকে নিয়ে গেল ৫০০০-এর ওপর রান আর ৪০০-র ওপর উইকেটে।

রানের ক্ষেত্রে এই উন্নতির পরিমাণ ১৩৮%, উইকেটের ক্ষেত্রে ৭৫%। সুতরাং যতই সানি, ভিভ, চ্যাপেল, জাভেদের মতো ব্যাটসম্যান বা লিলি, রবার্টস, হোল্ডিং, মার্শালের মতো বোলাররা থাকুন, এই স্বর্ণযুগে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন অলরাউন্ডাররাই।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...