আড়ালে আড়ালে পোড়া নক্ষত্র

শ্রীলঙ্কার বিখ্যাত স্কুল ক্রিকেটের মাধ্যমে উঠে আসা উপুল চন্দনার। মাহিন্দ্রা কলেজে পড়াকালীন সময়ে লাকি আরাম্বেওয়ালা আর দুলীপ নাভেন্দ্রর মতো কোচের অধীনে ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে যোগ দেন গল স্পোর্টস ক্লাবে। সেখানে স্ট্যানলি অমেন্দ্র এবং ওয়েদারত্নের অধীনে নিজের লেগস্পিনকে আরো ধারালো করে তোলেন তিনি।

১.

শ্রীলঙ্কার লোয়ার মিডল অর্ডারে কার্যকরী এক ক্রিকেটার ছিলেন উপুল চন্দনা। দুর্দান্ত লেগস্পিন করার পাশাপাশি বড় শট খেলতে পারেন, সঙ্গে যোগ করুন অনবদ্য ফিল্ডিং দক্ষতা। সব মিলিয়ে উপুল চন্দনা ছিলেন এক পরিপূর্ণ ক্রিকেটার।

যদিও ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা সময় ছিলেন মুত্তিয়া মুরালিধরণ নামের এক কিংবদন্তির ছায়ায়, কখনোই সেভাবে প্রচারের আলোয় আসতে পারেননি। কিন্তু পর্দার আড়ালে থেকে নিজের কাজটা করার চেষ্টা করে গেছেন সব সময়; কখনো তাতে সফল হয়েছেন, কখনো হননি।

২.

শ্রীলঙ্কার বিখ্যাত স্কুল ক্রিকেটের মাধ্যমে উঠে আসা উপুল চন্দনার। মাহিন্দ্রা কলেজে পড়াকালীন সময়ে লাকি আরাম্বেওয়ালা আর দুলীপ নাভেন্দ্রর মতো কোচের অধীনে ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে যোগ দেন গল স্পোর্টস ক্লাবে। সেখানে স্ট্যানলি অমেন্দ্র এবং ওয়েদারত্নের অধীনে নিজের লেগস্পিনকে আরো ধারালো করে তোলেন তিনি।

১৯৯১ সালে তিনি যোগ দেন তারকাপূর্ণ তামিল ইউনিয়ন ক্রিকেট ক্লাবে। সেখানে সতীর্থ হিসেবে পান চান্দিকা হাতুরুসিংহে, চম্পাকা রমানায়েকে, মুত্তিয়া মুরালিধরণের মতো ক্রিকেটারদের। মূলত সেখানে কাটানো দুই বছরই তার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। তামিল ইউনিয়ন ক্রিকেট ক্লাবে তিনি দুই বছর টানা ধারাবাহিক পারফর্ম করেন এবং তার দলও প্রেমাদাসা ট্রফি জিতে নেয় দুই বছরই। এই টানা পারফর্ম করার ফলেই ১৯৯৩ সালে ডাক পান জাতীয় দলে।

৩.

জাতীয় দলে ডাক পেলেও জাতীয় দলেও জার্সি গায়ে মাঠে নামতে সময় লাগে এক বছর। অবশেষে ১৯৯৪ সালের ১৪ এপ্রিল ২১ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অভিষেক হয় চন্দনার। অভিষেক ম্যাচে বল হাতে বলার মতো কিছু না করলেও ব্যাট হাতে ১৮ বলে ৩৭ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলেন।

১৯৯৬ সালে ভারত,অস্ট্রেলিয়া এবং শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে আয়োজিত ত্রিদেশীয় সিরিজে সাত উইকেট নিয়ে গ্লেন ম্যাকগ্রার সাথে যৌথভাবে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হন। শ্রীলঙ্কার ১৯৯৬ বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্যও ছিলেন তিনি।১৯৯৪ সালে একদিনের ক্রিকেটে অভিষেক হলেও টেস্টে অভিষেক হতে সময় লেগে যায় প্রায় পাঁচ বছর। অবশেষে ১৯৯৯ সালে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে পাকিস্থানের বিপক্ষে ম্যাচে টেস্ট ক্যাপ পান চন্দনা।

অভিষেক ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ১৭৯ রানে ছয় উইকেট নেন যা কিনা কাকতালীয়ভাবে তার ক্যারিয়ার সেরা। যদিও ম্যাচটি শ্রীলংকা ইনিংস ও ১৭৫ রানের বিশাল ব্যবধানে হেরে যায় কিন্তু ক্রিকেটবিশ্বকে আরেকবার তার আগমনের জানান দেন চন্দনা।

পরবর্তী পাঁচ বছর চন্দনা দলে আসা-যাওয়ার মাঝেই ছিলেন, কখনোই থিতু হতে পারেননি। ২০০৪ সালে মুরালিধরণ অস্ট্রেলিয়া সফর থেকে নাম প্রত্যাহার করলে দলে সুযোগ পান চন্দনা। সেখানে দ্বিতীয় টেস্টেই তুলে নেন ১০ উইকেট। সে সময় তিনি ছিলেন একমাত্র শ্রীলঙ্কান বোলার যিনি কিনা অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ১০ উইকেট নেন।

২০০৩ সালের জুনে বার্বাডোসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলেন ৭১ বলে ৮৯ রানের দুর্দান্ত ইনিংস। ছয়টি চার এবং চারটি ছয়ের সমন্বয়ে সাজানো এই ইনিংসের ফলেই শ্রীলঙ্কা ক্যারিবিয়ানদের দেয়া ৩১২ রানের বিশাল লক্ষ্য পেড়িয়ে যায় সহজেই। ২০০৪ সালের আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে কলম্বোতে তিনি তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রথম ও শেষ বারের মতো পাঁচ উইকেট পান।

২০০৪-০৫ মৌসুমে তিনি ৪১টি এক দিনের ম্যাচে ৩০ গড়ে ৫০ উইকেট নেন এবং প্রায় ২০ গড়ে ৪৪৮ রান করেন যা কিনা লোয়ার অর্ডার একজন ব্যাটসম্যানের জন্য ঈর্ষণীয়। ২০০৭ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচের মধ্য দিয়ে চন্দনা তাঁর ১৬ টেস্ট এবং ১৪৭ ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টানেন।

৪.

অধারাবাহিকতার পাশাপাশি মুত্তিয়া মুরালিধরণের অতি মানবীয় খেলার কারণে ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা সময় ধরেই দলে আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিলেন। কখনোই দলে স্থায়ী জায়গা করে নিতে পারেননি।কিন্তু তাতে দলের প্রতি তার আন্তনিবেদন কখনোই কমেনি। যখনই সুযোগ পেয়েছেন তখনই নিজের সেরাটা দিয়েই খেলেছেন।

১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপের প্রায় পুরোটা সময় বেঞ্চে বসে কাটালেও ভালো ফিল্ডার হওয়ায় প্রায় প্রতি ম্যাচেই বদলি ফিল্ডার হিসেবে মাঠে নামতে হতো তাকে। ইডেনের সেমিফাইনালে রোশান মহানামার বদলে ফিল্ডিং করছিলেন চন্দনা। যেহেতু তিনি খুব ভালো ফিল্ডার, তাই রানাতুঙ্গা তাকে ইনার সার্কেলের দিকেই রাখতেন।

ভারতের ওই ঐতিহাসিক ব্যাটিং বিপর্যয়ের পর দর্শকরা যখন ক্ষেপে গিয়ে যা পাচ্ছে তা-ই মাঠে ছুঁড়ছে, তখন তিনি রানাতুঙ্গার কাছে গিয়ে বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করার অনুমতি চাইলেন। রানাতুঙ্গা কারন জানতে চাইলে তিনি বলেন,  ‘ডি সিলভা বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়িয়ে ফিল্ডিং করছে, এখন কোনো অঘটনের মাধ্যমে যদি ডি সিলভার কিছু হয়ে যায় তবে সেটা আমাদের জন্য বিশাল ক্ষতি বয়ে আনবে। এর চেয়ে আমার সেখানেই যাওয়াটাই দলের জন্য মঙ্গলজনক।’

দলের প্রতি কতটা আত্মনিবেদন থাকলে একটা ম্যাচেও সুযোগ না পাওয়া খেলোয়াড় এত বড় ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত থাকে, সেটা একবার কল্পনা করে দেখুন তো!

৫.

তার জাতীয় দল থেকে অবসর নেয়ার ব্যাপারেও আছে ধোঁয়াশা। মূলত ২০০৭ বিশ্বকাপ দলে সুযোগ না পাওয়া থেকেই রাগে অবসর নেন তিনি, ‘তারা আমাকে হংকং সিক্সসে খেলার জন্যও বিবেচনা করেনি যেটা প্রমাণ করে তাঁরা আমাকে আর জাতীয় দলের জন্য বিবেচনা করেন না।’

নির্বাচকদের উপর দল নির্বাচনে দুর্নীতির অভিযোগ এনে এই দাবি করেন চন্দনা। যদিও নির্বাচকদের বক্তব্য ছিল ভিন্ন। তারা দাবি করেন তৎকালীন নিষিদ্ধ ক্রিকেট আসর ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগে (আইসিএল) খেলার জন্যই দ্রুত অবসর নেন চন্দনা। পরবর্তীতে আইসিএলে কলকাতা টাইগার্স এবং বিশ্ব একাদশের হয়ে খেলেন তিনি।

৬.

ক্রিকেট ছাড়ার পরে ২০০৯ সালে ‘চন্দনা স্পোর্টস’ নামে কলম্বোতে ক্রীড়া সামগ্রীর দোকান চালু করেন চন্দনা। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার ফ্র‍্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট দল গল গ্ল্যাডিয়েটর্সের বোলিং এবং ফিল্ডিং কোচ হিসেবে নিযুক্ত আছেন তিনি। আজকাল আর তাঁর কথা খুব একটা শোনা যায় না। আজও আড়ালেই আছেন তিনি।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...