ম্যারাডোনার সঙ্গে আমার দেখা মালিবাগ মোড়ে। কীভাবে, সেই গল্প পরে। আগে খোকাকে নিয়ে বলি।
২৫ বছর আগের কথা। খিলগাঁও রেলগেট থেকে টেম্পুতে চড়ে মালিবাগ হয়ে ফার্মগেট। প্রতিদিন সকালে এই যুদ্ধটা করতাম আমি আর শামীম। হাতে খাতা-কলম নিয়ে টেম্পুর পেছনে দৌড়াচ্ছি। কখনো টেম্পু ধরতে পেরেছি, কখনো পারিনি। কোচিং শুরু হয়ে যাওয়ার টেনশন নিয়ে পরের টেম্পুর জন্য অপেক্ষা করেছি।
যুদ্ধটা আমরা করতাম ডাক্তার হতে। মেডিকেলে ভর্তির কোচিং করতে বাসাবোর বাসা থেকে ফার্মগেট যেতাম। একদিন সকালে খিলগাঁও রেলগেটে এসে দেখি টেম্পুর পেছনে মানুষের ছোটাছুটি অন্য দিনের চেয়ে বেশি। কি ব্যাপার! সকাল ৭টায় রাস্তায় এত মানুষ কেন!
অনেক ঠেলা-ধাক্কা খেয়ে দুই বন্ধু একটা টেম্পুতে উঠতে পারলাম। টেম্পু বদলাতে (খিলগাঁও থেকে সরাসরি ফার্মগেটের টেম্পু ছিল না। মালিবাগ এসে ফর্মগেটের টেম্পুতে উঠতে হতো) মালিবাগ নেমে আবার ধাক্কা খেলাম। আজ হলোটা কি? সকাল সকাল সব মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে গেছে!
বিস্ময়ের সেখানেই শেষ নয়। কোচিং সেন্টারে পৌঁছে দেখি ক্লাশও শুরু হয়ে গেছে। কি করে সম্ভব! আমার ঘড়িতে তখনো সাতটাই ঠিকমতো বাজেনি, আর ক্লাশ তো শুরু হওয়ার কথা আটটায়! আমাদের দরজায় দেখে অবাক হলেন স্যার। ক্লাশের অন্যরাও। আর ক্লাশের ঘড়িতে তাকিয়ে অবাক আমরা। ঘড়িতে আটটা পেরিয়ে গেছে আরও আগে!
দুষ্টামিটা ছিল খোকার। আমাদের কোচিংয়ে দেরি করিয়ে দিতে সে-ই বাসার দেয়াল ঘড়িটা এক ঘন্টা পিছিয়ে রেখেছিল, সেই সঙ্গে কোনো এক ফাঁকে আমার হাত ঘড়িও। বন্ধু-বান্ধব মিলে একসঙ্গে এক বাসায় থাকলে যা হয় আর কি!
তো ক্লাশে ঢুকতে না পেরে বাসায় ফেরার পথে আবার মালিবাগ নামলাম। নাস্তা করতে ঢুকলাম মালিবাগ মোড়ের এক রেস্টুরেন্টে। ঢোকার সময় রেস্টুরেন্টের নাম দেখে থমকে দাঁড়ালাম। ম্যারাডোনা রেস্টুরেন্ট।
১৯৮৬ এর বিশ্বকাপের তখন মাত্র ৯-১০ বছর। ম্যারাডোনার কারিকুরি আমাদের মনে জীবন্ত। ফুটবল খেলতে মাঠে নামলে নিজেকে ম্যারাডোনা ম্যারাডোনা মনে হতো। কেউ ল্যাং মারলে মনে হতো আমাকে নয়, ম্যারাডোনাকে মেরেছে। এখানে একটু বলে রাখি, ম্যারাডোনা আমাদের প্রজন্মের সৌখিন ফুটবলারদের একটা ক্ষতি করে দিয়েছিলেন। তাকে দেখে খেলার মাঠে আমরাও কাউকে পাস না দিয়ে ৬-৭ জনকে কাটাতে চাইতাম এবং অবধারিতভাবে ১-২ জনকে কাটিয়েই হুমড়ি খেয়ে পড়তাম। শাহরুখ খানদের না হয় চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়লে কিছু হয় না, আমরা তো মানুষ!
যাই হোক, মালিবাগ মোড়ের ম্যারাডোনা রেস্টুরেন্টের মালিক আমাদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। আমরা ফুটবল পায়ে ম্যারাডোনাকে নকল করতে চেয়েছি, এই ভদ্রলোক তাঁর রেস্টুরেন্টের নামই রেখে দিয়েছিলেন ম্যারাডোনার নামে। ওই দিনের পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই ম্যারাডোনা রেস্টুরেন্টে নাস্তা করেছি। যেন ম্যারাডোনা রেস্টুরেন্টে যাওয়া মানেই ম্যারাডোনার দেখা পাওয়া!
খোকা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে আরো আগে। এবার চলে গেলেন ম্যারাডোনাও। মালিবাগ মোড়ের ম্যারাডোনা রেস্টুরেন্টটা কি আছে? অনেকদিন যাওয়া হয় না ওই দিকে।
– ফেসবুক থেকে