ব্যক্তিনির্ভরশীলতার সংকট

ব্যক্তি নির্ভরশীলতা কখনো কোন গোষ্ঠীর জন্য উপকার বয়ে আনে নি, ইতিহাস সাক্ষী। ব্যক্তি নির্ভরশীলতা এক একটা দলকে চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাড় করিয়েছে, এর সাক্ষ্যও ইতিহাসেই আছে। রাজনীতি, রণনীতি, ক্রিকেট, ফুটবল সবক্ষেত্রেই এর কোন ব্যতিক্রম নেই। লিওনেল মেসি, বার্সেলোনা, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল থেকে শুরু করে ক্রিকেটে সাউথ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা, জিম্বাবুয়ে, আরসিবি, কতশত উদাহরণ!

২০১৫ পরবর্তী সময়ে ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত সংস্করণগুলোতে যে পরিবর্তনটি এসেছে, বাংলাদেশ তার সিংহভাগ কৃতিত্ব দাবী করতেই পারে। বাংলাদেশের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়াটা ইংলিশরা মানতে পারেন নি, তায় আবার অস্ট্রেলিয়ার মাটি থেকে। তাদের ক্রিকেট নিয়ে চিন্তার জায়গায় আমূল পরিবর্তন ঘটে।

৩০০ বল বা ১২০ বল খুব বেশি বল না, এমন ব্যাটসম্যান চাই, যারা দ্রুত রান করতে সক্ষম, এমন বোলার চাই, যারা প্রতিপক্ষের রান আটকে রাখতে সক্ষম, সাথে ব্যাটটাও চালাতে জানেন। ওয়ানডে এবং টি২০ ক্রিকেট থেকে বিদায় নেন ইয়ান বেল, স্টুয়ার্ট ব্রড, জেমস এন্ডারসনের মত বড় বড় নাম। উত্থান ঘটে বেয়ারেস্টো, জেসন রয়, লিয়াম প্ল্যাংকেট এর মত খেলোয়াড়দের।

সামগ্রিক খেলোয়াড়ি দক্ষতা বলতে আমরা সাধারনত যা বুঝি, সেই বিচারে প্ল্যাংকেট-জেসন রয়রা সম্ভবত এন্ডারসন-বেলদের থেকে বেশ পিছিয়েই থাকবেন কিন্তু ইংল্যান্ডের চাওয়ার যায়গা নির্দিষ্ট। জেসন রয়ের থেকে বেলের ধারাবাহিকতা তারা আশা করেন নি, আশা ছিলো প্রতিপক্ষকে গুড়িয়ে দেয়ার মানসিকতা।

লিয়াম প্ল্যাঙ্কেটের থেকে অ্যান্ডারসনের নিখুঁত বোলিংয়ের চাহিদা ছিলোনা, চাহিদা ছিলো মিডল ওভার গুলোতে তার বোলিং ভ্যারিয়েশন রানের গতি শুকিয়ে দিবে। খেলোয়াড়ের দক্ষতার উপরে বোর্ডের চাহিদা তৈরি হয় নি, আগে থেকেই চাহিদা নির্ধারণ করে সেই অনুযায়ী খেলোয়াড় নির্বাচন করা হয়েছে। তাদেরকে তৈরি করা হয়েছে, সুযোগ দেয়া হয়েছে।

শুরুতেই কিন্তু সফলতাও এসে হাজির হয় নি, অনেকগুলো ম্যাচে তারা বেশ বাজেভাবে হেরেছেন। আমরা বারবার জানিয়েছি, এই ফর্মুলা দীর্ঘমেয়াদি না, যেইদিন ধ্বস নামবে, সেইদিন কেউ ঠেকাতে পারবে না। আমাদের আশংকাকে সত্য প্রমাণের জন্য চেয়েছি ইংল্যান্ড হেরে যাক। কিন্তু তারা তাদের পরিকল্পনায় স্থির ছিলেন, কাজ করছে না বলে দুই সিরিজ পরপর খেলার ধরন পরিবর্তন করে ফেলেননি।

ফলাফল চোখের সামনে। এখন তারা এমন এক ব্র‍্যান্ডের ক্রিকেট খেলছেন, যেখানে প্রতিপক্ষ মাঠে নামার আগেই ভয় পেতে বাধ্য। আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা কিংবা অস্ট্রেলিয়া ছোট-বড় কারো নিস্তার নেই। ফলে বাকিরাও একই ব্র‍্যান্ডের ক্রিকেট খেলতে বাধ্য হচ্ছেন। ক্রিকেটের চিন্তার জায়গাটিতেই পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। এখানে যে কোন বল মারা যায়, যে কোন পরিস্থিতিতে মারা যায়। সমীকরণ বেশ সহজ, ব্যাটসম্যানের দায়িত্ব রান তোলা, যত দ্রুত সম্ভব রান তোলা। বোলারের দায়িত্ব রান থামানো, সে উইকেট নিয়েই হোক আর রান শুকিয়ে দিয়েই হোক।

বিশ্ব ক্রিকেটের এত বড় পরিবর্তনের মূল কারণ হয়েও সমীকরণে কোন পরিবর্তন ঘটে নি কেবলমাত্র আমাদেরই। আমরা ২০০৩ সালের ক্রিকেটটাই এখনো খেলে চলেছি। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের পরে সামান্য সময়ের জন্য যেই সাহস দেখিয়েছিলাম, ২০১৬ শেষ হওয়ার আগেই আমাদের সাহসও শেষ। অবশ্য, চান্দিকা হাতুরুসিংহের বিদায়ের পরে প্রথমবারের মত আমরা উচ্চারণ করেছিলাম, আমরা ভয়-ডরহীন ক্রিকেট খেলতে চাই।

হাতুরুর হেডমাস্টারসুলভ আচরণ আমাদের প্রতিভার সঠিক মূল্যায়নে বাধা, নতুন ফর্মুলার নাম দেয়া হলো ‘বাংলাদেশি ব্র‍্যান্ড অব ক্রিকেট’। ফর্মুলাটি টিকে ছিলো সর্বসাকুল্যে ৪ ম্যাচ, পঞ্চম ম্যাচে(শ্রীলঙ্কা-জিম্বাবুয়ের সাথে ট্রাই নেশন সিরিজের ফাইনাল) সাকিবের আঙুলের ইনজুরির সাথে ফর্মুলারও ইনজুরি ঘটে।

অদ্ভুত, অযৌক্তিক এক যুক্তি আমরা সামনে ঠেলে দেই, পরিস্থিতির কারণে আমরা রক্ষনাত্মক খেলতে বাধ্য হচ্ছি(!), তামিমকে এংকরের দায়িত্ব পালন করতে হয় এবং সেকারনে তিনি তার এমন ব্যাটিং নিয়ে সন্তুষ্ট। মুশফিককে মিডল অর্ডার সামলাতে হয়, তিনি অ্যাঙ্করের দায়িত্ব পালন করেন, তিনি তার ব্যাটিং নিয়ে সন্তুষ্ট। রিয়াদকে লোয়ার মিডল অর্ডার নিয়ে ব্যাটিং করতে হয়, তিনি এঙ্করের দায়িত্ব পালন করেন, তিনি তার ব্যাটিং নিয়ে সন্তুষ্ট। সেই একইভাবে লিটন, নাঈম, সৈকতরাও তাদের ব্যাটিং নিয়ে সন্তুষ্ট। সরাসরি তিনটা প্রশ্ন হওয়া উচিত।

১। কোন বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যে কেবলমাত্র আমাদের বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের পড়তে হয় যা বড় সকল দলের ব্যাটসম্যানদের তো পড়তে হয়ই না,এমনকি ধ্বংস হয়ে যাওয়া সাউথ আফ্রিকান ক্রিকেটের কুইন্টন ডি কক, মালান, মিলার কিংবা প্রায় অখ্যাত আয়ারল্যান্ডের পল স্টার্লিং, কার্টিস ক্যাম্ফার বা সিমি সিংদেরও পড়তে হয় না? তারা কিভাবে দ্রুত রান তোলার জন্য ক্রিকেট খেলতে পারেন?

২। পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে এই ম্যারম্যারে ক্রিকেট খেলে বাংলাদেশের উপকার কি? ক্যারিয়ার শেষে তামিম-সাকিব-মুশফিকের ওয়ানডেতে দশ হাজার রান থাকতে পারে, রিয়াদের ছয়-সাত হাজার রান থাকতে পারে, প্রত্যেকের গড় ৪০ এর কাছাকাছি থাকতে পারে কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট কি পাবে? ৭ জন ব্যাটসম্যানের ৪ জনের গড় ৪০ এর কাছাকাছি হলে, তারা এমন কোন বিপর্যয়ে পড়েন যে দ্রুত রান তোলার সুযোগ থাকে না? ৮-৯ নম্বর পজিশনে আরো দুইটা মিনি অলরাউন্ডার খেলানোর কারন কি?

৩। নিজেদের তৈরি করে নেয়া পরিস্থিতি থেকে বের হবার উপায় কি? কবে এই পরিস্থিতি থাকবে না? যদি আমরা নেগেটিভ ক্রিকেটের চর্চাই করে যাই, কোন জাদুবলে হঠাৎ করে আমরা পজিটিভ ক্রিকেট খেলতে পারবো? না কি আমরা কেবল সম্মানজনক হারের সাথে এখানে সেখানে দুই-একটা জয়ের জন্য ক্রিকেট খেলবো?

উত্তর সবার জানা। ভয়ে ভয়ে ক্রিকেট খেলা হয় না, নিজের জায়গা বাচানোর জন্য ক্রিকেট খেলা যায় না। ব্যক্তিগত অর্জনের জন্য ক্রিকেট খেলে দলের উপকার হয় না। ভক্তরা জানেন, বোর্ড জানেন, খেলোয়াড়েরাও জানেন, তারপরেও আমরা এই ক্রিকেটটা খেলে যাই। আমাদের সিনিয়ররা আবার আনটাচেবল, তাদের খেলার ধরন নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না, তাদের ফিটনেস নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না, তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না।

একজন ওপেনার ৭০-৭৫ স্ট্রাইক রেট নিয়ে খেলে ম্যাচের শুরুতেই হেরে গেলে প্রশ্ন তোলা যাবে না, একজন মিডলঅর্ডার ব্যাটসম্যানের প্রায় ৫০ শতাংশ বল ডট থাকলে প্রশ্ন তোলা যাবে না, একজন ফিনিশার ওভারপ্রতি ৮-১০ রান লাগার পরেও দ্রুত রান বের করতে না চাইলে প্রশ্ন তোলা যাবে না। পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করছে এমনভাবে খেলতে, আমাদের মেনে নিতে হবে!

ব্যক্তি নির্ভরশীলতা কখনো কোন গোষ্ঠীর জন্য উপকার বয়ে আনে নি, ইতিহাস সাক্ষী। ব্যক্তি নির্ভরশীলতা এক একটা দলকে চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাড় করিয়েছে, এর সাক্ষ্যও ইতিহাসেই আছে। রাজনীতি, রণনীতি, ক্রিকেট, ফুটবল সবক্ষেত্রেই এর কোন ব্যতিক্রম নেই। লিওনেল মেসি, বার্সেলোনা, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল থেকে শুরু করে ক্রিকেটে সাউথ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা, জিম্বাবুয়ে, আরসিবি, কতশত উদাহরণ!

বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হয়েও লিওনেল মেসি গত কয়েক বছর ধরে ইউসিএল থেকে খালি হাতে ফিরছে বার্সেলোনার খেলোয়াড় নির্ভরশীল প্রক্রিয়ার জন্য। চারজন খেলোয়াড়ের বিদায় শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটকে প্রায় ধ্বংসের মুখে দাড় করিয়ে দিয়েছে। প্রতিবছর হেভিওয়েট টীম বানিয়েও আইপিএলে বারবার ব্যর্থ রয়েল চ্যালেঞ্জারস ব্যাঙ্গালুরু।

তারপরেও আমরা ব্যক্তি নির্ভরশীল দল বানাই, তারা তাদের মত খেলবেন এবং ফলাফল যা হবে তাই মেনে নেই। এটা ক্রিকেট না, ব্যক্তি যত বড়ই হোক না কেন, আপনার ফর্মুলার সাথে না মিললে তাকে বসিয়ে দিতে হবে। ফর্মুলার সাথে আপোস করা যায় না। জো রুটের মত খেলোয়াড়কে ইংল্যান্ড টি২০ ক্রিকেটের জন্য বিবেচনায় আনছে না, এই ভদ্রলোকের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার গড় ৩৭, স্ট্রাইক রেট ১২৫+।

আইসিসি ওয়ানডে ব্যাটিং র‍্যাঙ্কিংয়ে ২ নাম্বারে থাকা অবস্থায় জোনাথন ট্রটকে ইংল্যান্ড বসিয়ে দিয়েছে, ডেভিড মালান টি২০ ব্যাটিং র‍্যাঙ্কিংয়ের ১ নাম্বারে থেকেও দল থেকে বাদ পড়তে পারেন, ইংল্যান্ডের ফর্মুলার সাথে না মিললে। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, এম এস ধোনী ভারতীয় ক্রিকেটের রিবিল্ডিং শুরুই করেছিলেন আনটাচেবলদের টাচ করে, আজ তারা অজেয়। ইতিহাস প্রতি মুহুর্তে আমাদের জানান দেয়, ব্যক্তি নয়, প্রক্রিয়া ধরো, সফলতা আসবে, আমরা শিক্ষা নেই না।

আমাদের খেলোয়াড়দের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক, কর্মকর্তাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। দশ হাজার রান নিয়ে তামিম-মুশফিক বিশ্বের সেরাদের কাতারে চলে আসবেন না, ৬-৭ নাম্বার পজিশনে সবথেকে বেশি রান করে রিয়াদও অমর হয়ে যাবেন না কিন্তু ভয়-ডরহীন ক্রিকেট তাদের একটা এরা (era) তৈরি করে দিয়ে যেতে পারে, যেমনভাবে রানাতুঙ্গা, ইমরান খান বা গিলক্রিস্টরা তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন। আমাদের সমর্থকদেরও শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। অন্যথায়, আমাদের এংকররা ভুল জায়গায় নোঙর ফেলে বসে থাকবেন, সাইলেন্ট কিলাররা নিভৃতেই ক্রিকেটটাকে খুন করে চলে যাবেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...