স্মৃতিমেদুর যুগলাঙ্গুরীয়

ভারতবর্ষের নব্যযুগের দুই ফিল্ডিং রিফরমার। আজকাল অনেক বড়োবড়ো ভারতীয় পার্টনারশিপ নিয়ে সাহিত্য লেখা হয় - লেখাই উচিত। এই যেমন সৌরভ-শচীন কি শচীন- শেবাগ, ধোনি-যুবি টেস্টে শচীন-দ্রাবিড় অথবা পুরাকালের সানি-শ্রীকান্ত কিংবা হালের রোহিত-বিরাট। এদের মধ্যে কাইফ-যুবি নামটা যেন বিস্মৃতির শেষ চ্যাপটার, অথচ এদের যুগলবন্দী লেগে আছে সেই ছোটোবেলা থেকে, এদের যুগলবন্দী লেগে আছে ব্যাট-পিচ ছাড়িয়ে গোটা মাঠজুড়ে, এদের যুগলবন্দী লেগে আছে কখনও পয়েন্ট ছাড়িয়ে শর্ট লেগের ফিল্ডিংয়ে কখনও বা লং অনের লম্বা দৌড়ের উড়ন্ত ক্যাচে। ব্যাটিং-ফিল্ডিং-ম্যান টু ম্যান চার্জিংয়ের ত্রিশক্তি। সাহারা জার্সির একটুকরো ছোটোবেলা। এমন যুগলবন্দী আর পাবেন কি?

অবসর উত্তর জীবন। দুই বন্ধুর মধ্যে কথাবার্তা চলছে। তাঁদের কথাবার্তার সংক্ষিপ্ত বাংলা তর্জমাটা নীচে দেওয়া হলো।

প্রথম বন্ধু দ্বিতীয়জনকে – এতো ভালো ভালো ইনিংস খেলেছো। তবু তোমার সর্বশ্রেষ্ঠ ইনিংস হিসাবে আমি রাখব অজিদের বিপক্ষে করা সেই ৫৮ রানটা। উফফ, খুব তাড়াতাড়ি উইকেট পড়ে গিয়েছিল, আর সেখানে তুমি নেমেই পিটাতে শুরু করেছিলে।

দ্বিতীয় বন্ধু প্রথমজনকে -না, ওইদিন তাড়াতাড়ি উইকেট পড়েনি। ২০২ রানে দ্বিতীয় উইকেট পতনের পর আমি নেমেছিলাম। তবে আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ তুমি আমাকে চার নম্বরে প্রমোট করেছিলে বলে।

সন্ধ্যা ঘনাবার সাথে সাথে আকাশী চাদর সরিয়ে নেমে আসে গাঢ় নীলের মসলিন। প্রভাতে ধানের ক্ষেতে হাতে হাত ধরে চলা দুই বন্ধুর সময় হয়ে যায় বিদায় নেবার। একজনের স্মৃতি এখনও টাটকা; আরেকজন নিজেই তলিয়ে গেছে বিস্মৃতির আড়ালে। একসাথে তাদের ঘর বাঁধা হয়নি বেশিক্ষণের জন্য। কিন্তু বোঝাপড়া তো ক্ষণ মানে না; মানে বিশ্বাস,মানে একজনের তর্জনীর অভিমুখ নিমেষে অন্যজনের বুঝে যাওয়ার অভ্যাস। বোঝাপড়া তো নিজেই একটা অভ্যাস। এই অভ্যাসকেই তো আমরা বলি ‘যুগলাঙ্গুরীয়’।

সেই দুই বন্ধুর অবসরোত্তর জীবনে এখন বর্তমান শুধুই পূর্বের নস্টালজিক বিউটি। যে ম্যাচের কথা বলছে তারা, সেটা ২০০০ সালের অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ। তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ। সেবার বৈশাখী সন্ধ্যায় এক চাঁদের রাত্রে প্রথমবার সাক্ষাতের মজ্জায় নিমজ্জিত ছিল ভাবী ইতিহাসের গূঢ় তত্ত্ব।

তাঁরা সেবার জানত না, যে তাদের পারস্পরিক সাক্ষাৎ ভারতবর্ষের নব্যযুগ নির্মাণে এত গভীরভাবে প্রভাব ফেলে যাবে। একজন সেবার অধিনায়ক, আর অন্যজন অধিনায়কের সবচেয়ে বিশ্বস্ত অস্ত্র। অনূর্ধ্ব ঊনিশ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে কলম্বোর প্রেমদাসা স্টেডিয়ামে মুখোমুখি ভারত-অস্ট্রেলিয়া।

তখনও তরুণ মিশেল জনসন কি শেন ওয়াটসনের আগুনকে সেবার গিলে খেয়েছিল এক পাঞ্জাবি। অধিনায়কের নির্দেশে টু ডাউনে নেমে ২৫ বলে ৫৮ এর এক ঝোড়ো ইনিংসে অজি ঔদ্ধত্যের অসহায় আত্মসমর্পণ ত্বরান্বিত হয়। সেবার চ্যাম্পিয়ন ভারত। সেই যুগলপ্রেমিকের একসাথে পথ চলার প্রথম মাইলফলক। তারপর সেই রাস্তা এগিয়েই গেছে,এগিয়েই গেছে; আর রাস্তার ধারে ধারে পোঁতা হয়েছে মাইলফলক; বিভিন্ন ক্ষণে; বিভিন্ন সনে। তারা মোহাম্মদ কাইফ আর যুবরাজ সিং।

২০০০ সালের অনূর্ধ্ব ঊনিশ বিশ্বকাপের অধিনায়ক আর অধিনায়কের প্রধান অস্ত্র।তারা ১১ আর ১২। আবার তারা কখনও টপ অর্ডার ফেলিওরের পর সৌরভ গাঙ্গুলির সাহারা জার্সির ভারতের একমাত্র ‘দিশারা’। ভারতবর্ষের প্রথম একজোড়া অ্যাথলিট বয়। একজন পয়েন্টের ইগল আর একজন লংয়ের বাজপাখি।একজন মহম্মদ আর একজন সিং যেবার হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেরিয়েছিল, সৌরভ গাঙ্গুলীর ভারত তখন লবিহীন, রাজনীতি হীন, ধর্মহীন।

ন্যাটওয়েস্ট ফাইনাল, ২০০২। লর্ডসের ব্যালকনিতে মহারাজও নখ কামড়েছিল, ভগবানও উইকেট ছেড়ে খেলতে গিয়ে বোল্ড হয়েছিল। ‘দেওয়াল’-এও ধরেছিল চিড়। টিভির সুইচ বন্ধ হয়েছিল। কেউ স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে ধরেছিল ওয়েলিংটন রোডের পথ।

কিন্তু তারা সবাই ফিরেও এসেছিল। টিভির সুইচ আবার অন হয়েছিল। মহারাজ জার্সি উড়িয়েছিল। সৃষ্টিকর্তা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে চওড়া হাসি হেসেছিল। স্টেডিয়াম-আউট দর্শক ওয়েলিংটন রোডের মাঝপথ থেকে আবার ফিরে এসেছিল লর্ডসে। কারণ একজন মোহাম্মদ কাইফ আর একজন যুবরাজ সিং আঁকড়ে ধরেছিল ক্রিজটাকে।

ন্যাটওয়েস্ট ফাইনালেরই একটা ঘটনার কথা বলি। পার্টনারশিপের সূত্র ছিল যুবরাজ পেটাবে, কাইফ ধরবে। কিন্তু আস্কিং রেটের স্বতঃস্ফূর্ত বাড়বাড়ন্তে তখন দুজনকেই চালিয়ে খেলতে হতো। ড্রেসিংরুম থেকে সৌরভ চিৎকার করছে – ‘টেক আ সিঙ্গেল, টেক আ সিঙ্গেল, গিভ স্ট্রাইক টু যুবরাজ’। যুবরাজ দাদার ঈশারা বুঝতে পেরে কাইফকে বললো সে কথা। কাইফের কোনো হেলদোল নেই। পরের বলটা এল শর্টে – কাইফের পুল -ছক্কা! ব্যাট ঠুকতে ঠুকতে কাইফ যুবরাজকে বললো – ‘হাম ভি খেলনে আয়ে হ্যায়’।

১৩ জুলাই, ন্যাটওয়েস্ট জয়ের দিন। ন্যাটওয়েস্ট, ২০০২ মানে শুধুমাত্র সৌরভের জার্সি ওড়ানো নয়। ন্যাটওয়েস্ট মানে সেই কাইফ-যুবরাজের যুগলাঙ্গুরীয়ের আংটি, যে আংটির রশ্মি জ্বলজ্বল করেছে তখনই, অন্ধকার এসেছে যখন। কাট টু চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, ২০০২। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মাস্ট উইন ম্যাচ।

সাতাশিতেই পাঁচটা পড়েছিল। সেখানেও মোহাম্মদ কাইফের ১১১, ম্যাচ জিতিয়েছিল ভারতকে। আবার অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বারবার জ্বলে উঠত যুবরাজ। দুজনেরই প্রধান শক্তি ফ্লিক (ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়)। জার্সি নম্বরটাও কেমন পরপর ১১ আর ১২। আর ফিল্ডিংয়ে কখনও যুবরাজের পয়েন্টে ড্রাইভ সাজঘরে ফিরিয়েছে মার্টিনকে, কখনও কাইফের স্ট্রেটে লম্বা দৌড় হতাশ করেছে ইনজামাম-ইউনুসদের।

ভারতবর্ষের নব্যযুগের দুই ফিল্ডিং রিফরমার। আজকাল অনেক বড় বড় ভারতীয় পার্টনারশিপ নিয়ে সাহিত্য লেখা হয় – লেখাই উচিত। এই যেমন সৌরভ-শচীন কি শচীন- শেবাগ, ধোনি-যুবি টেস্টে শচীন-দ্রাবিড় অথবা পুরাকালের সানি-শ্রীকান্ত কিংবা হালের রোহিত-বিরাট। এদের মধ্যে কাইফ-যুবি নামটা যেন বিস্মৃতির শেষ চ্যাপটার, অথচ এদের যুগলবন্দী লেগে আছে সেই ছোটবেলা থেকে, এদের যুগলবন্দী লেগে আছে ব্যাট-পিচ ছাড়িয়ে গোটা মাঠজুড়ে, এদের যুগলবন্দী লেগে আছে কখনও পয়েন্ট ছাড়িয়ে শর্ট লেগের ফিল্ডিংয়ে কখনও বা লং অনের লম্বা দৌড়ের উড়ন্ত ক্যাচে। ব্যাটিং-ফিল্ডিং-ম্যান টু ম্যান চার্জিংয়ের ত্রিশক্তি। সাহারা জার্সির এক টুকরো ছোটবেলা। এমন যুগলবন্দী আর পাবেন কি?

ইন্ডিয়ান ওয়েল কাপ, ২০০৫। প্রতিপক্ষ উইন্ডিজ। অধিনায়ক তখন রাহুল দ্রাবিড়। কাইফ যখন ব্যাট করতে এল ভারত তখন ৫১/৩। আবার শুরু হলো যুবি-কাইফের সেই পুরোনো অ্যাম্বাস্যাডার। যেন দীর্ঘদিনের বসে যাওয়া ইঞ্জিনে মবিল ঢেলেছে কেউ। আগেই বলেছি যুগলাঙ্গুরীয়ের আংটির রশ্মি তখনই জ্বল জ্বল করেছে, যখনই অন্ধকার এসেছে। স্ট্রেড ড্রাইফ, পাঞ্চ কাট, ফ্লিকের সারিসারি শিল্প বেয়ে সেই পার্টনারশিপ যখন শেষ হলো, তখন ভারতের স্কোর ২১৬/৪। আমার দেখা এই জুটির শেষ রোশনাই।

তারপর ভারতীয় ক্রিকেটে মহাযুগ এসেছে। কালের অধ্যায়ে একজন টিকে গেছে, আর একজন হারিয়ে গেছে স্রোতের ধারায়। একজন ভারতবর্ষের দু দুটো বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম কারিগর, আরেকজন সেই বিশ্বজয় দেখেছে বাড়িতে বসে। চোখে জল নেমেছে। এখানে তারও থাকার কথা ছিল। থাকতে পারেনি।

কিন্তু, সেই ঊনিশ বছর বয়স থেকে যাকে চেনে, তাঁর মৃত্যুঞ্জয়ী ইনিংসের চোখের জলে সেদিন কি সত্যিই চুপ করে ছিলেন সেই মোহাম্মদ? ১১’ এর ফাইনালের রাত্রে যুবরাজের কান্নায় সত্যিই কি কাঁদেননি মোহাম্মদ কাইফ? অবসরোত্তর জীবনে তাদের দেখা হওয়াটা যেন অনেকবছর পর সন্ধ্যায় ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা শব্দের মাঝেই দুই বন্ধুর বিবাগী স্মৃতির বাক্যালাপ।

সেই বাক্যালাপে উঠে আসে আন্ডার নাইন্টিন বিশ্বকাপ, উঠে আসে ন্যাটওয়েস্ট ফাইনাল, উঠে আসে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। আর শেষবেলায় ছেড়ে যাবার মুহুর্তে একজন হয়তো অপরজনকে বলে যায় – ‘বন্ধু তোমার বিশ্বজয়ের রাত্রে আমি মাঠে ছিলাম না। কিন্তু মাঠে তোমার চোখের জলের কিছু ফোঁটাতে আমার নাম লেখা ছিল, আর আমার চোখের জলটাতে তোমার নাম।’

কিছু না বলা বন্ধুত্বের কথায়, কিছু না ফোটা বন্ধুত্বের কুঁড়িতে আজও যে কত কত কাইফ আর যুবির চোখের জল এক হয়ে যায়, জানিনা! জানিনা!

সাক্ষী রইল সাহারা জার্সির একটুকরো স্মৃতিমেদুর যুগলাঙ্গুরীয়। এভাবেই বারবার যুগলবন্দী হোক মোহাম্মদ কাইফ আর যুবরাজ সিংয়ের মত অন্য কারো, যুগে ‍যুগে, বারেবার।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...