প্রিয় মেসি সমীপে…

আমি একটা বাসায় ৯ বছর ছিলাম। সেই বাসা ছেড়ে আসার সময় আমাকে কান্না চাপতে হয়েছে। আর এই ক্লাবটাতে আপনি প্রায় দুই দশক পার করে ফেললেন। এই ক্লাবেই আপনার জীবনের সব বন্ধু, এই ক্লাবেই আপনার যত হাসি, যত কান্না। এমন একটা বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা নিশ্চয়ই সোজা না।

প্রিয় লিও,

সেই দিনটার কথা মনে আছে? সেই না হওয়া গোলটার কথা?

আপনার মনে থাকার কথা নয়।

আপনি জীবনে কতো শত অবিশ্বাস্য গোল করেছেন। ডি বক্সের বাইরে থেকে বাঁক নেওয়া সাপের মতো গোল, ছয় জন খেলোয়াড়কে পেছনে ফেলে চোখ নিশ্চল করে দেওয়া গোল কিংবা ছোট একটা ছোয়ায় গোলক্ষককেই মুগ্ধ করে ফেলা গোল।

আপনার তো গোলের অভাব নেই। সেখানে একটা ‘না হওয়া’ গোলের কথা মনে রাখতে হবে কেনো!

আপনার কোনো দায় নেই। কিন্তু আমাদের কাছে যে জীবনের ওটাই সবচেয়ে বড় সম্পদ হয়ে আছে। হ্যা, ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে আপনার সেই ‘সলো রান’টার কথা বলছিলাম। মাঝ মাঠ থেকে কার কাছ থেকে যেনো বল পেয়ে সর্পিল একটা দৌড় দিলেন আপনি। বক্সের এক কোনা থেকে আলতো টোকা। ভিনসেন্ত এনাইমার ওপর সেই সময়কালে কী যেনো ভর করেছিলো। ২০১০ বিশ্বকাপের মতো আরও একটা অবিশ্বাস্য সেভ করেছিলেন তিনি।

কে যেনো কানের কাছে বললো, ‘গোলটা হলে এটাও শতাব্দীর সেরার লড়াইয়ে থাকতো।’

তাই কী?

সেদিন আমরা সব ভুলে গিয়েছিলাম। ওই দিনটাতেই আমাদের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সাকিব আর সহঅধিনায়ক তামিমকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিলো দায়িত্ব থেকে। ক্রিকেট পাগল জাতির জন্য সেটা ছিলো বিরাট খবর, ক্রিকেট রিপোর্টার হিসেবে আমার সেই খবর নিয়েই পড়ে থাকার কথা ছিলো। কিন্তু আপনার ওই অবিশ্বাস্য দৌড়ের পর আমি আর ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারিনি।

জানেন মেসি, আমি সেভাবে ফুটবলের খোজ খবর রাখতে পারি না; আসলে কোনো খেলার সাংবাদিকতা করারই ঠিক যোগ্য নই আমি। পাকেচক্রে সাংবাদিক হয়েছি। তবে আপনার সাথে আমার সম্পর্কটাকে আমার এই কম বোঝা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না।

আমার প্রথম প্রেম ছিলেন ম্যারাডোনা।

তখন গ্রামের একটা স্কুলে প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেনীতে পড়ি। আমার কোনো স্কুল ব্যাগ ছিলো না। বাবা একদিন ঘোরতর বর্ষার সময় একটা হলুদ পলিথিনের ব্যাগ এনে দিয়েছিলেন; বই নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেই ব্যাগটার ওপর ম্যারাডোনার ছবি ছাপা ছিলো।

অস্পষ্ট, কুকড়ে যাওয়া সেই ছবিটা আমাকে আজও তাড়া করে বেড়ায়। সেই ছবিটার মধ্যে কী একটা মায়া ছিলো, যা আমি আর কোথাও খুজে পাইনি।

ভুল বললাম, বহুকাল পরে এসে বার্সেলোনায় খেলতে থাকা শিশুসুলভ এই আপনার মুখে আমি সেই ম্যারাডোনার মুখ খুজে পেয়েছিলাম।

ম্যারাডোনা থেকে মেসি; এই দুটো নিষ্পাপ মুখেই যত প্রাপ্তি। টিভিতে খেলা দেখতে শেখার পর থেকে আপনাদের দলকে কিচ্ছুটি জিততে দেখিনি।

হ্যা, বার্সেলোনায় আপনার কিছু খেলা দেখেছি। বার্সেলোনা!

আমার কাছে বার্সেলোনা মানে বোর্হেসের সেই ন্যু ক্যাম্প কিংবা একটা কাতালান স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীক। আমার হাই প্রেশার। রাত জাগলে খারাপ লাগে। গত দুই চার বছর তাই সেইটুকু খেলাও দেখি না। মাঝে মাঝে আপনি ভালো খেললে হাইলাইট দেখি আমি।

তাই ফুটবলার হিসেবে আপনার ন্যু ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়াটা আমার কাছে ততো অর্থবহ হয়তো নয়। কিন্তু আমি এটুকু বুঝতে পারি আপনি একটা দর্শন ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিংবা আপনি জীবনটাই বদলে ফেলতে চাচ্ছেন।

আমি একটা বাসায় ৯ বছর ছিলাম। সেই বাসা ছেড়ে আসার সময় আমাকে কান্না চাপতে হয়েছে। আর এই ক্লাবটাতে আপনি প্রায় দুই দশক পার করে ফেললেন। এই ক্লাবেই আপনার জীবনের সব বন্ধু, এই ক্লাবেই আপনার যত হাসি, যত কান্না। এমন একটা বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা নিশ্চয়ই সোজা না।

আমি জানি না, আপনি কোথায় যাবেন?

যেখানেই যান, আমি আপনার সাথেই থাকবো। হয়তো রাত জেগে খেলা দেখবো না; কিন্তু শুভকামনাটা থাকবে। আর বার্সেলোনা!

নিশ্চয়ই ন্যু ক্যাম্পের সবুজ ঘাস আপনার অপেক্ষায় থাকবে। এই ঘাসগুলো নিশ্চয়ই চুপচাপ প্রতীক্ষায় থাকবে কবে আবার একজন মেসি, একজন জাভি, একজন ইনিয়েস্ত আলতো করে বসে হাত বুলিয়ে দেবেন তাদের গায়ে।

হয়তো আপনারা সশরীরে ফিরবেন না এই ঘাসের ওপর। তারপরও ঘাসগুলো অপেক্ষা করবে।

আমরাও অপেক্ষা করবো।

ইতি

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...