শরণার্থী শিবিরে বড় হওয়া আফগান স্বপ্ন

১৫ জুলাই, ১৯৮৪। এরই মাঝে কাবুলে এক মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয় ছোট্ট এক শিশু। নাম নওরোজ মঙ্গল। যুদ্ধের পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় জান বাঁচাতে সাধারণ মুসলিমরা তখন পাকিস্তান সীমান্তে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেখানেই শরণার্থী ক্যাম্পে বেড়ে উঠতে থাকে সেই শিশুটি। ছেলেবেলার বেশিরভাগ সময়ই তাকে কাটাতে হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। পাকিস্তান সীমান্তে পেশোয়ারের কোহাত রোড শরণার্থী ক্যাম্পে পরিবার সহ আশ্র‍য়ে ছিলেন বেশ খানিক সময়। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সাথে তালেবানদের যুদ্ধে আফগান নাগরিকদের জীবন তখন প্রায় বিপন্ন অবস্থা।

সেসময় সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের পর শুরু হওয়া রক্তাক্ত এক গৃহযুদ্ধে জয়ী হয়ে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তালেবানরা। আফগানিস্তানে তালেবানরা তখন ক্ষমতার শীর্ষে বলা চলে। আল কায়েদাকে পেছন থেকে সমর্থন দিয়ে সন্ত্রাসী শিবির গড়ে তুলছিলো। যুক্তরাষ্ট্র সহ ব্রিটিশদের উপরও বেশ কয়েকবার হামলা চালায় এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। কয়েক দেশের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ, বোমা হামলায় আফগানিস্তান বিধ্বস্থ প্রায় অবস্থা। এমন অবস্থায় সাধারণ মুসলিমদের জন্য সেখানে দিন-রাত যেনো সমান।

১৫ জুলাই, ১৯৮৪। এরই মাঝে কাবুলে এক মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয় ছোট্ট এক শিশু। নাম নওরোজ মঙ্গল। যুদ্ধের পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় জান বাঁচাতে সাধারণ মুসলিমরা তখন পাকিস্তান সীমান্তে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেখানেই শরণার্থী ক্যাম্পে বেড়ে উঠতে থাকে সেই শিশুটি। ছেলেবেলার বেশিরভাগ সময়ই তাকে কাটাতে হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। পাকিস্তান সীমান্তে পেশোয়ারের কোহাত রোড শরণার্থী ক্যাম্পে পরিবার সহ আশ্র‍য়ে ছিলেন বেশ খানিক সময়। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সাথে তালেবানদের যুদ্ধে আফগান নাগরিকদের জীবন তখন প্রায় বিপন্ন অবস্থা।

ওই ক্যাম্পেই ক্রিকেটের সাথে পরিচিত হন মঙ্গল। ক্যাম্পের মাটিতে ক্রিকেট খেললেও কখনো যেনো স্বপ্নেও তিনি ভাবেননি আফগানিস্তানের হয়ে জাতীয় দলে খেলবেন। ময়লার মধ্যেই ক্রিকেট খেলতেন তিনি। তখন পাকিস্তান দল ক্রিকেটে বেশ শক্ত অবস্থানেই ছিলো। ক্রিকেট তখন বেশ জনপ্রিয় খেলা ছিলো সেখানে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খেলা দেখার জন্য কোনো টিভি ছিলো না। ক্রিকেট ম্যাচ দেখা যেনো বিলাসিতার চেয়েও বেশি কিছু ছিলো।

তখনো কোনো ম্যাচ টিভিতে দেখার সুযোগ হয়নি মঙ্গলের। ইমরান খান, শচীন টেন্ডুলকার এবং ওয়াসিম আকরামদের নাম তখন লোকেমুখে শুনেছিলেন তিনি। এরপর ১৯৯৬ এর বিশ্বকাপে প্রথম টিভিতে ম্যাচ দেখার সুযোগ হয় নওরোজের। সেই ম্যাচটি ছিলো ভারত বনাম পাকিস্তানের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ। যেখানে প্রথমবার শচীন, আকরামদের মুখ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো তাঁর।

১৯৯৫ সালে আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (এসিবি) গঠন করা হয়। সে সময় আফগানিস্তানের কোচ করা হয় তাজ মালিককে। যিনি যুদ্ধের সময় বর্ডারে নওরোজ মঙ্গলের প্রতিভা দেখে তাকে দলে নিতে আগ্রহ দেখান। তিনি ভ্রমণ করে চলে যান পাকিস্তান বর্ডারে নওরোজের বাবাকে মানাতে। তাজ মালিক নওরোজের বাবার কাছে অনুরোধ করেন ছেলেকে ক্রিকেটে দিতে।

কিন্তু, দেশের ওই পরিস্থিতিতে নওরোজের বাবা এই অনুরোধে কর্ণপাত করেননি। তার বাবা চাইতেন বাকি দুই ভাইর মতো সেও ডাক্তার হবে। আর ডাক্তার হয়ে তারই দেশের যুদ্ধাহত সেনাদের চিকিৎসা করবে। দেশের এমন অবস্থা ক্রিকেটের কথা শুনে বেশ অবাকও হন নওরোজের বাবা। এরপর অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর রাজী হন নওরোজের বাবা।

২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার পর সন্দেহভাজনদের ধরে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য আমেরিকা এবং তার মিত্র দেশগুলো তালেবানকে চাপ দেয়। তখনও তা মানতে অস্বীকার করে তালেবানরা। এরপর আমেরিকান এবং ব্রিটিশ সৈন্যদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় নর্দার্ন আ্যালায়ান্স নামে তালেবান বিরোধী একটি আফগান মিলিশিয়া গোষ্ঠী অভিযান চালিয়ে তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করে। যুদ্ধ বন্ধের পর পরিবার সহ নিজ দেশে ফিরে যান মঙ্গল। তালেবানদের সেই যুদ্ধ বন্ধের পর নতুনকরে আফগানিস্তানে ক্রিকেট দল গঠন করা হয়।

২০০১ সালে আন্তজার্তিক ক্রিকেট সংস্থার (আইসিসি) সহযোগী সদস্যপদ লাভ করে আফগানিস্তান। একই বছর ২০০১ সালে নাউশেহরার বিপক্ষে অভিষিক্ত হন নওরোজ মঙ্গল। ২০০৩ সালে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল (এসিসি) এর সদস্যপদ লাভ করে আফগানরা।

২০০৪ সালে এসিসি ট্রফিতে ওমানের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পণ করেন নওরোজ। ওই টুর্নামেন্টে ২৭১ রান করে আফগানিস্তানের পক্ষে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন তিনি। তাঁর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সেই টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে যায় আফগানিস্তান। তবে কুয়েতের কাছে হেরে বাদ পড়েন তারা। মঙ্গলের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স ওই টুর্নামেন্টে আফগানিস্তান ক্রিকেটে এক নতুন মাত্রা যোগ করে।

পরবর্তীতে ২০০৭ সালে নওরোজ মঙ্গল আফগানিস্তান জাতীয় দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পান। তার অধীনে আফগানিস্তান ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগে (ডব্লিউসিএল) ডিভিশন ৫ থেকে ডিভিশন ১ এ উন্নীত করে। ২০০৯ সালে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে আফগানরা।

আর নিজেদের প্রথম ম্যাচেই নওরোজের নেতৃত্বে জয়ের রেকর্ড গড়ে আফগানিস্তান। ২০১০ সালে তাঁর অধীনেই এসিসি ট্রফি জয় করে আফগানিস্তান। একই বছর অক্টোবরে কেনিয়ার বিপক্ষে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে মেইডেন সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি। যেখানে ১৬৮ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন নওরোজ।

২০১০ সালে নওরোজকে সরিয়ে অলরাউন্ডার মোহাম্মদ নবিকে অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। নতুন অধিনায়কের অধীনে দলের পারফরম্যান্স দ্রুত উন্নতি হতে লাগলো। নবির নেতৃত্বে টি-টোয়েন্টি এশিয়ান গেমসের সেমিফাইনালে পাকিস্তানকে পরাজিত করে আফগানরা। তবে ফাইনালে বাংলাদেশের কাছে হেরে শিরোপা হাতছাড়া করে তাঁরা।

অধিনায়কত্ব থেকে বাদ পড়লেও দলের নিয়মিত মুখ ছিলেন নওরোজ। পরবর্তীতে ২০০৯-১০ ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের ফাইনালে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। প্রথমবার এই টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েই শিরোপা জয় পায় আফগানরা। তখন থেকেই বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদেরকে প্রমাণ করতে শুরু করেন আফগানরা।

ফুটবল তখন আফগানিস্তানে খেলাধুলায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তবে ক্রিকেটের সাফল্য ফুটবলকেও ছাড়িয়ে যেতে লাগলো জনপ্রিয়তায়। ২০১০ সাল থেকেই আফগানিস্তানে ফুটবলের চেয়ে ক্রিকেট বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এক সাক্ষাৎকারে নওরোজ বলেছিলেন, ‘যুদ্ধবিদ্ধস্ত এক দেশ যেখানে যেকোনো সময় বোমা পড়তে পারে! সেই দেশের রাস্তায় বাচ্চারা ক্রিকেট খেলছে এটা যেনো অবিশ্বাস্য।’

এরপর দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ২০১১ বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে আফগানিস্তান পঞ্চম হয়। এবং প্রথম আইসিসির সহযোগী দেশ থেকে পূর্ণ সদস্যপদ লাভের মর্যাদা পায় আফগানিস্তান। এই সাফল্যের পর তৎকালীন আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই এই সাফল্যে বেশ উচ্ছ্বসিত হন। পরবর্তীতে আফগানিস্তান ক্রিকেটকে উন্নয়ের জন্য অনেক সহযোগিতা করেন তিনি। এরপর ২০১১ সালে আবারো অধিনায়কের দায়িত্ব পান মঙ্গল।

নওরোজ মঙ্গল ছোটবেলা থেকেই শচীন টেন্ডুলকারের অনেক বড় ভক্ত। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যখন অবস্থান করছিলেন, ১৯৯৯ সালে সেখানে তাঁর এক বন্ধু শচীনের পোস্টার এনে দিয়েছিলো। আর সেটি কোথাও না লাগিয়ে সবসময়ই সাথে নিয়ে ঘুরতেন তিনি। শচীনকেই তিনি সবসময় আদর্শ মেনেছেন, শচীনকেই তিনি অনুপ্রেরণা মানেন। তাঁর একটাই স্বপ্ন শচীনের অটোগ্রাফ সংগ্রহে রাখা।

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ৪৭ ওয়ানডেতে ১০৯৬ রান করেছেন তিনি। আরব আমিরাতের বিপক্ষে আছে ব্যাক্তিগত সর্বোচ্চ ১২৯ রান। ৩০ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ৪৫৪ রান সংগ্রহ করেন তিনি। যেখানে পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ৬৫ রান করেন নওরোজ। ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর পর বর্তমানে তিনি আফগানিস্তান ক্রিকেটে প্রধান নির্বাচকের দায়িত্ব পালন করছেন।

শরণার্থী ক্যাম্পে বেড়ে উঠা নওরোজ মঙ্গলের হাত ধরেই আফগানিস্তান ক্রিকেটের উত্থান। তাঁর হাত ধরেই বিশ্বক্রিকেটে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে আফগানরা। বোমার শব্দে যাদের ঘুম ভাঙতো, সেই আফগানরাই আজ ক্রিকেট যুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যস্ত।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...