সুইংয়ের সুলতান বনাম অজি কবিতা

বয়সের ভারে মন্থর হয়েছেন আকরাম, রিফ্লেক্স কমলেও কবজির মোচড়ে ব্যাটটা একবার ঘুরিয়ে নেন স্টিভ, জীবনে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ বাঁচানো ইনিংস খেলে গেছেন স্টিভ আর অন্যদিকে, আকরাম ক্রিকেট বিশ্বের বন্দিত ম্যাচ উইনার- দুই বিজয়ীর লড়াইতে আদৌ কে বিজয়ী তাঁর উত্তর লেখা নেই কোনও রেকর্ড বইতে, সেই চিরন্তন প্রতিদ্বন্দ্বীতার আঁচ যেন ছিল উপমহাদেশের সাথে ডনের দেশের কৌলীণ্যের লড়াই, দুই ব্যক্তিত্বের উষ্ণ স্পর্শ, উইলোকাঠের দুই ব্রহ্মাস্ত্রের এক কালজয়ী দ্বৈরথ।

সিডনিতে বিদায়ী টেস্টে নামছেন স্টিভ ওয়াহ। সে সময়ে ইরফান পাঠানকে মনের মতো করে গড়ছেন বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সুইং বোলার। আডিলেডে সৌরভ লম্বা স্পেলে রিকি পন্টিংয়ের সামনে ইরফানকে ফেলে দিলে চাপে পড়ে যাচ্ছে ভদোদরার বাচ্চা ছেলেটা- সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠছেন সুইংয়ের সুলতান।

টি ব্রেকে ওয়াহের বিদায় প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, ‘স্টিভের যা প্রাপ্য ও তাই পাচ্ছে, এমনটাই তো হওয়া উচিৎ একজন রাজকীয় ক্রিকেটারের বিদায়ে।’

চোখের কোলটা কি চিকচিক করে উঠল? শচীনের সামনে সেঞ্চুরিয়নে পড়ন্ত ওয়াসিম আকরামের মন খারাপ কতদূর বাউন্ডারি পেরিয়েছিল জানতে চাইল না তো কেউ কোনোদিন,আধুনিক ক্রিকেটের সবচেয়ে ভয়ংকর সুইং বোলারের বিদায় লগ্নটুকু এত অন্ধকারে সেরেছিল পাক বোর্ড- তবু নিজের ক্যারিয়ারের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বীর রাজকীয় বিদায়ে যেন খুশির পেয়ালাই চলকে দিলেন আক্রম- ক্রিকেট জেন্টলম্যানস গেম? ইনডিড!

১৯৯২-৯৭ সময়কালটা বোধ হয় বিশ্বের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রাজত্ব হাতবদলের সাক্ষী। আর অদ্ভুতভাবে এই সময়টাতেই নি:শব্দে বিশ্বের সর্বকালের সেরা বোলিং-এর ব্লু-প্রিন্ট এঁকেছিলেন ‘সুইং অব সুলতান’। রিচি রিচার্ডসনের হাতে পড়ে ক্ষয়িষ্ণু ক্যারিবিয়ান সাম্রাজ্যের শেষ ব্যাটনটা নিয়ে লড়ে যাচ্ছিলেন প্রিন্স, ব্রায়ান চার্লস লারা।

কিন্তু ৯৫-এর মে মাসে ক্যারিবিয়ানদের সেই টানা ১৫ টি সিরিজ অপরাজিত থাকার ঐতিহাসিক রেকর্ড ভেঙে পড়ল ভিভের দেশে এবং চতুর্থ জামাইকান টেস্টে অ্যামব্রোসের সামনে যেন ত্রাস হয়ে উঠলেন স্টিভ ওয়াঘ- ডাবল সেঞ্চুরি- শুরু হল ক্রিকেট বিশ্বে হলুদ দৌরাত্ম!

কিন্তু, স্টিভের এই মসৃণ জয় রথের মাঝে নিজের ব্যাটিং ক্যারিয়ারে একটা বড় কাঁটা হয়ে রইলেন এক পাকিস্তানি, অ্যামব্রোসের সাথে নব্বইয়ের শুরু থেকে যে লড়াইটা লড়তেন স্টিভ তার সমান্তরালেই চলছিল আকরাম-ওয়াহ দ্বৈরথ। ৯০-এর দশকে আকরাম নিজের ক্যারিয়ার গড়কে নিয়ে যান প্রায় ২০-তে,ম্যাচ প্রতি উইকেট ৫ যা টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ফিগার!

তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আমব্রোস-ডোনাল্ড আর ম্যাকগ্রাকে তিনি অনেকটা পেছনে ফেলে দেন এই সময়টাতেই। বিশ্ব জয়ের পর ইমরানের পাকিস্তান উপমহাদেশের অন্যতম শক্তি হিসেবে উঠে এল অচিরেই। অন্যদিকে, স্টিভ ব্যাটিং গড়ে শচীন-লারা ও গ্রাহাম গুচের থেকে সামান্য পিছিয়ে থাকলেও প্রায় সাড়ে ছ’হাজার রানের পাহাড় জমিয়েছিলেন স্টিভ এই সময়ে । কিন্তু ওয়াঘের দুরন্ত স্কোয়ার কাট, লম্বা লেংথের বলে কব্জির লেগগ্লান্স, কিংবা খাটো লেংথের সপাটে পুল থাকলেও তাঁর দূর্বলতার জায়গাটাতেই হয়ত এক মারণাস্ত্র আকরামের হাতে দিয়েছিলেন ক্রিকেট বিধাতা- ইনসুইং ইয়র্কার!

স্টিভ নব্বইয়ের শুরু থেকে যে সাবলীলভাবে অ্যামব্রোসকে খেলতেন, আকরামের সামনে সেই সাবলীলতা আসত না এই একটি মারণাস্ত্রের জন্যই। ১৯৮৯-৯০ তে ঘরের মাঠে আকরামের ইনসুইং ইয়র্কারে ক্রিজে যেন থমকে যান স্টিভ। সেই বদলাটা সুদে আসলে তুলতে স্টিভের সময় লেগেছিল বেশ কটা বছর। ততদিনে বিশ্বকে রিভার্স সুইংয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ক্রিকেট ঈশ্বরের বরপুত্র।

তবু, ওয়াহের সাথে তাঁর লড়াই ও চলছে সমানতালে। মার্টিন ক্রো রিভার্সের রহস্য প্রথম ফাঁস করলেও ওয়াঘও পিছিয়ে থাকেন নি। রিভার্সের সাথে নিজের পায়ের মুভমেন্টকে ঠিক করতে আকরামকে খেলার আগে তিনি নিয়ে নিতেন বিশেষ ট্রনিং। ১৯৯৪-৯৫ রাওয়ালপিন্ডিতে আকরামের ডেরায় স্টিভ যেতেই পুরনো ইনসুইং ইয়র্কার শুরু করার চেষ্টা করেন আকরাম কিন্তু ক্রিজের দৈর্ঘ্যকে কাজে লাগিয়ে অনায়াসেই তা খেলার কায়দা ততদিনে রপ্ত করে ফেলেছেন স্টিভ।

ক্যারিয়ারের শীর্ষে থাকা স্টিভ সে সময়ে আইসকুল ওয়াহ, বরফের মতো ঠাণ্ডা মাথার জন্য এই নামে তিনি বেশ পরিচিতই ছিলেন ক্রিকেট মহলে। আকরাম শুরু করলেন গতি বাড়িয়ে আউটসুইং, স্টিভ জানতেন এই ফাঁদ নতুন, তাই আকরামের বাঁকানো সুইং-এর বাণ শান্ত ভাবে ছাড়তে থাকলেন তিনি। বিরক্ত আকরাম গতি বাড়ালেন, কিন্তু স্টিভ ততক্ষণে জমে গেছেন ক্রিজে- শেষ করলেন ৯৮ রানের মহামূল্যবান ইনিংস খেলে – স্টিভ ওয়াহ দ্বৈরথ পেড়িয়ে এই ইনিংসটি হয়ে রইল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাইশ গজের উত্তেজনায় হাত সেঁকার চিরন্তন রসদ।

অনেক বছর পর আকরাম বলেছিলেন, ‘স্টিভের ওপর রাগটা এতই বেশি হচ্ছিল সে সময়ে মনে হচ্ছিল হয়ত খুনই করে দেব।’

আর ওয়াহ? হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘আমার ক্রিজে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল আকরাম হয় আমাকে অত্যন্ত অপছন্দ করে নইলে আমি ভুল সময়ে ভুল জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েছি।’ ওয়াহ’র কথাই যেন এক কবিতা- যেভাবে তিনি দম বন্ধ অজি ড্রেসিংরূমে নিয়ে এসেছিলেন খোলা হাওয়া, সেভাবেই যেন হাসতে হাসতে বলে যেতে পারেন নিজের প্রবলতম প্রতিদ্বন্দ্বীর কথা, খোলামেলা, অকপট !

সর্বসাকুল্যে ১৩ বার টেস্টে স্টিভের সামনাসামনি এসেছেন আকরাম, তাঁর মধ্যে ৪ বার স্টিভকে ক্রিজে ধরাশায়ী করেছেন আকরাম, আবার আকরাম সমৃদ্ধ পাকদলের বিরুদ্ধে ব্যাটিং গড় ৪৫- ধরে রেখেছেন স্টিভ। আকরাম স্টিভের সামনে তিনটি অস্ত্র প্রয়োগ করেছেন বিভিন্ন সময়ে, শুরুতে ইনসুইং ইয়র্কার, তারপর আউটসুইং এবং শেষে প্রবল গতির খাটো লেংথ, স্টিভ বরফের মতো মস্তিষ্কে খেলেছেন তিনটি অস্ত্রকে তিনভাবে।

অপেক্ষা করেছেন কখন আকরাম প্রথম থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয়তে যাবেন কারণ স্টিভের অঞ্চলে আক্রমকে নিয়ে আসার লড়াইটুকুই তিনি করতেন – ক্রিকেট ? না মাইন্ড গেম?

স্টিভ আর ওয়াসিম আকরামের লড়াই কোথায় আলাদা? ম্যাকগ্রা-শচীন কিংবা লিলি-ভিভের লড়াই-এর আগুন কখনোই ছড়ায়নি আকরাম-স্টিভ লড়াইতে, স্টিভের উদাস মন আর চেনা অস্ট্রেলীয় টেকনিকের আন্টিডোট হয়েছিল আকরামের মিষ্টি হাসি আর ঈশ্বরপ্রদত্ত সুইং,নব্বই-এর দশকে এ লড়াই-এর কথা উঠলে আজও হেসে ওঠেন দুজনে।

বয়সের ভারে মন্থর হয়েছেন আকরাম, রিফ্লেক্স কমলেও কব্জির মোচড়ে ব্যাটটা একবার ঘুরিয়ে নেন স্টিভ, জীবনে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ বাঁচানো ইনিংস খেলে গেছেন স্টিভ আর অন্যদিকে, আকরাম ক্রিকেট বিশ্বের বন্দিত ম্যাচ উইনার- দুই বিজয়ীর লড়াইতে আদৌ কে বিজয়ী তাঁর উত্তর লেখা নেই কোনও রেকর্ড বইতে, সেই চিরন্তন প্রতিদ্বন্দ্বীতার আঁচ যেন ছিল উপমহাদেশের সাথে ডনের দেশের কৌলীণ্যের লড়াই, দুই ব্যক্তিত্বের উষ্ণ স্পর্শ, উইলোকাঠের দুই ব্রহ্মাস্ত্রের এক কালজয়ী দ্বৈরথ।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...