শূন্য থেকে অনন্য

চলতি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) আগে কখনো সুযোগই পাননি। যদিও, সুযোগ পেয়েই ‘ধামাকা’ উপহার দিলেন। নিজের মাত্র চতুর্থ আইপিএল ম্যাচে তিনি পর পর দুই বলে বিরাট কোহলি ও গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের উইকেট নিলেন। এরপর এবি ডি ভিলিয়ার্সকে নিজের শিকার বানিয়ে ম্যাচ জয়ী ১৯ রানে ৩ উইকেটের ফিহার নিয়ে শেষ করলেন। এর আগে ব্যাটিংয়ে ১৭ বলে ২৫ রান করেন।

এই সেদিনও তাঁকে কেউ চিনতো না। কিন্তু গত ৩০ মার্চের ম্যাচের পর তাঁকে চিনতে কেউ আর বাকি নেই। এই ‘জিরো থেকে হিরো’ বনে যাওয়া মানুষটির হলেন হারপ্রিত ব্রার।

চলতি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) আগে কখনো সুযোগই পাননি। যদিও, সুযোগ পেয়েই ‘ধামাকা’ উপহার দিলেন। নিজের মাত্র চতুর্থ আইপিএল ম্যাচে তিনি পর পর দুই বলে বিরাট কোহলি ও গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের উইকেট নিলেন। এরপর এবি ডি ভিলিয়ার্সকে নিজের শিকার বানিয়ে ম্যাচ জয়ী ১৯ রানে ৩ উইকেটের ফিহার নিয়ে শেষ করলেন। এর আগে ব্যাটিংয়ে ১৭ বলে ২৫ রান করেন।

  • কে এই হারপ্রিত ব্রার?

বয়স ২৫ বছর বাঁ-হাতি স্পিনার, লোয়ার-মিডল অর্ডারে টুকটাক ব্যাটিং করতে জানেন। পাঞ্জাবের ছোট শহর মোগা থেকে উঠে এসেছেন। যে জায়গা থেকে এসেছে ভারতীয় নারী ক্রিকেটার হারমানপ্রিত কৌর। কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবে দল পাওয়ার আগে পাঞ্জাবের বয়স ভিত্তিক দল ও ক্লাব ক্রিকেটে খেলেছেন ব্রার। মাত্র ২৩ বছর বয়সে ২০১৯ আইপিএলে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব তাকে ২০ লাখ রুপিতে কিনে নেয়।

  • কেমন ছিল শৈশব?

তখন ব্রার একদমই শিশু। একটি ক্রিকেট অ্যাকাডেমির পোস্টার দেখলো মার্কেটের সাথে লাগোয়া এক দেওয়ালে। পেশাদার ক্রিকেটার হওয়ার ইচ্ছা ব্রারের সেদিন থেকেই। সেই পোস্টার বাড়ি নিয়ে গেল, তাঁর মাকে দেখাল। তা মা তাকে বলেন, ‘দেখো, তুমি ইচ্ছা করলে এখানে যেতে পারো, কিন্তু যদি তুমি এখানে তোমার মন দিতে পারো তবে।’

তার মা এটা বলেছিলেন কারণ ব্রার এমন এক পরিবার থেকে এসেছিলো যাদের অনেকেই ক্রিকেট খেলতো। কিন্তু তার অধিকাংশ কাজিনই এক সময় আর্থিক সমস্যায় ক্রিকেট ছেড়ে দেয়। অনেক চাপ থাকা সত্ত্বেও স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে একটু একটু করে বড় হবার পর অনূর্ধ্ব-১৬ এবং অনূর্ধ্ব-১৯ দলে পাঞ্জাবের হয়ে খেলা শুরু করে। একটা সময় ছিলো যখন সে বিয়ের বিপক্ষে ছিলো কারণ তাঁর স্বজনেরা অনেকেই খোঁচা দিয়ে বলেছিল – ‘ক্রিকেট? সে তো পুরো দুনিয়াতেই খেলেন। কোনো ভবিষ্যৎ নেই ওখানে।’

তাঁদের বলার যথেষ্ট কারণও ছিল। বয়স ভিত্তিক দলে জায়গা হয়েছে অনেক দফা হোঁচট খাওয়ার পর। এরপর সাত বছরে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব দলে ট্রায়াল দিয়ে বাদ পড়েন। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি।

কিন্তু ব্রার চেয়েছিলো তাঁদেরকে ভুল প্রমাণ করতে। পরিবারও সাফ বলে দিয়েছিল ক্রিকেটার হতে না পারলে পাঞ্জাব পুলিশে যোগ দিতে হবে৷ সেখানে বাবা ড্রাইভার হিসেবে কাজ করতো। না হয়, স্টুডেন্ট ভিসায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য কানাডা চলে যেযে হবে। কিন্তু ব্রার চেয়েছিলেন শেষ বারের মতো ক্রিকেটে চেষ্টা করতে।

  • যেভাবে দিলেন কঠিন পথ পাড়ি?

২০১৮ সালে যখন সে অনূর্ধ্ব-২৩ দলে খেলছিলেন তখন ব্রার বুঝতে পারলেন সময়টা তাঁর ভালো যাচ্ছে না। মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে দুবার ট্রায়াল দিলেও ব্যর্থ হন। এরপর পাঞ্জাব ক্রিকেটার গুরকিরাত সিংয়ের চেষ্টায় মোহালি জেলা দলের সুযোগ পান ব্রার। সেখানে সুযোগ পেয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেন। তখন তাঁর ব্যাট কেনার মতও সামর্থ্যও ছিলো না! গুরকিরাত তাঁকে সেখানেও সাহায্য করে।

তিনি বলেন, ‘ব্যাটের অনেক দাম ছিলো। তাই আমরা চেষ্টা করতাম একটা ব্যাট লম্বা সময় টিকে। একটা সময় গুরকিরাত আমাকে একটি ব্যাট উপহার দেন।’

২০১৮ সালে অনূর্ধ্ব-২৩ সি.কে নাইড়ু ট্রফি ব্রারকে বোলার হিসেবে অনেক উপরে নিয়ে আসে। ১১ ম্যাচে ১৬.৪১ গড়ে ৫৬ উইকেট শিকার করেন তিনি! ছয় বার পাঁচ উইকেট সহ ২৩ রানে সাত উইকেট ছিলো সেরা ফিগার! এরপরই ২০১৯ আইপিএলের জন্য কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব তাঁর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়।

  • কেমন ছিল ২০১৯ পরবর্তী যাত্রা?

২০১৯ আইপিএলে ব্রার দিল্লী ক্যাপিটালসের বিপক্ষে তার টি-টোয়েন্টি অভিষেক কয়৷ টসের সময় তার অধিনায়ক রবিচন্দ্রন অশ্বিন তাকে ‘মিস্ট্রি স্পিনার’ হিসেবে আখ্যা দেয়। ১২ বলে ২০ রান করে ব্যাট হাতে দারুন পারফরম্যান্স দেখায় ব্রার। তবে বল হাতে ভালো করতে পারেননি তিনি! এক ওভারে ১৭ রান দেন তিনি, এরপর আর মাত্র একটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পান তিনি। সেই মৌসুমে তিনি কোনো উইকেট নিতে পারেননি।

একই বছর শেষের দিকে ব্রার মুশতাক আলী ট্রফিতে পাঞ্জাবের হয়ে খেলেন। ৬.৮৯ ইকোনমি রেটে ১৪ উইকেট শিকার করেন তিনি, যা পাঞ্জাবের হয়ে ঐ সেশনে সর্বোচ্চ! তার সাথে পাঞ্জাবের বোলিং লাইন আপে ছিলেন সন্দীপ শর্মা, সিদ্ধার্থ কৌল ও মায়াঙ্ক মারাকান্দে! সেই মৌসুমে ব্রার উইকেট নিয়েছিলেন দেবদূত পাদ্দিকাল, দীনেশ কার্তিক ও পৃথ্বী শ এর মতো ব্যাটসম্যানদের।

প্রায় দশ মাস পর ২০২০ আইপিএল খেলতে আরব আমিরাত যান ব্রার। সেখানে মাত্র এক ম্যাচে সুযোগ পান তিনি! ৪ ওভারে ৪১ রান দেন এবং ১০ উইকেটে সেই ম্যাচের হারে তাঁর দল।

২০২১ সালে মুশতাক আলী ট্রফিতে শুরুর দিকে ব্রার আবারো বল হাতে দারুণ পারফরম করেন। সাত ম্যাচে ৫.৭০ ইকোনমি রেটে সাত উইকেট শিকার করেন তিনি। লিগ পর্বে পাঞ্জাব এক ম্যাচেও হারের দেখা পায়নি! এরপর থেকে পাঞ্জাবের হয়ে মূল বোলিংয়ের ভূমিকাগ সান্দিপ শর্মা, মারাকান্দেদের সাথে ব্রারও রয়েছেন।

  • আইপিএলের জাদুকরী রাত

প্রথম ৬ ম্যাচের চারটি তেই হারের পর রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর বিপক্ষে তিন পরিবর্তন নিয়ে মাঠে নামে পাঞ্জাব কিংস। সেখানে ব্রার তার আইপিএলের ৪র্থ ম্যাচ খেলার সুযোগ পায়।

প্রথমে ব্যাট করে সাতে নেমে ১৭ বলে ২৫ রানের ইনিংস খেলেন ব্রার। হার্শাল প্যাটেলের ৫ বলেই ১৮ রান নেন তিনি! দুই ছয় ও এক চারে পাঞ্জাব কিংসকে ৫ উইকেটে ১৭৯ রান করতে সাহায্য করেন ব্রার। কিন্তু আসল জাদু দেখান তিনি বল হাতে!

প্রথম বলেই ছক্কার মারের পর ব্রার পর পর দুই বলে বিরাফ কোহলি ও গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে বোল্ড করে নিজের মেইডেন আইপিএল উইকেটের শিকার বানান। পরের ওভারেই এবি ডি ভিলিয়ার্সকে এক্সট্রা কভারে ক্যাচ আউট করে নিজের ৩য় শিকার বানান ব্রার। আইপিএলে ২০১৯ সাল থেকে করা ১১ ওভারে ১০৬ রান দিয়ে তিনি কোনো উইকেট নিতে পারেননি! সেখানে এই মৌসুমে প্রথম ম্যাচেই তিন উইকেট শিকার করেন তাও সেটা বর্তমান সময়ে টি-টোয়েন্টির সেরা তিন ব্যাটসম্যানের উইকেট।

ব্রার ম্যাচ সেরার পুরস্কার জয়ের পর বলেন, ‘আমার প্রথম আইপিএল উইকেট বিরাট কোহলির, যার জন্য আমি অনেক খুশি। যখন আপনি এক উইকেট পাবেন তখন কিছুটা মেন্টালিটি পরিবর্তন হয়, আপনি কনফিডেন্স পান যে ঠিক জায়গায় বল করতে পারছেন যার জন্য আমি আরো উইকেট পেয়েছিলাম।’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...